কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণ দিবস
কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণ দিবস।
![]() |
কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণ দিবস |
Kali Banerjee's death anniversary
১৯৯৩ সালের ৫ জুলাই। অভিনেতা কালী বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াত হন। তিনি ৭১ বছর বয়সে আজকের দিনে লখনৌ শহরে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর অভিনীত জনপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘অযান্ত্রিক’, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’, ‘নাগরিক’ ইত্যাদি।
জন্ম:
১৯২০ সালের ২০ নভেম্বর, কলকাতার কালীঘাটে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মণীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় একজন আইনজীবী ছিলেন। এগারো জন ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর পরিবারের আদি নিবাস পূর্ববঙ্গের ঢাকা, বিক্রমপুর। তাঁর বয়স যখন দশ, তাঁর বাবা লেক মার্কেট অঞ্চলে রাজা সীতারাম রোডে একটি বাড়ি তৈরি করে থাকতে শুরু করেন। ঠাকুরদা পুলিশে চাকরি করতেন। বাবা মণীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন আইনজীবী, রাশভারী রক্ষণশীল মানুষ। মা ভবানীদেবী।
কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিক্ষাজীবন :
বিদ্যালয় জীবন:
লন্ডন মিশনারিতে প্রাথমিক এবং সত্যভামা ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি খুব আগ্রহী ছিলেন। ফুটবল, লাঠি খেলা, ছোরা খেলায় তিনি পারদর্শী ছিলেন।কালী বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই লিখেছেন, “ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে বাবা খুব কড়া ছিলেন। কিন্তু আমার ঝোঁক পড়াশোনার থেকে বেশি ছিল খেলাধুলার দিকে।”
ফুটবল খেলায় তিনি এতটাই ভাল ছিলেন যে, বিভিন্ন ক্লাব তাঁকে ভাড়া করে নিয়ে যেত খেলাতে। আর প্রায় সব ম্যাচের শেষে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার তিনিই পেতেন। পুরস্কার বিতরণ করতে এসে একবার বিস্মিত গোষ্ঠ পাল জিজ্ঞেস করেছিলেন কালী বন্দোপাধ্যায়কে, “আচ্ছা খোকা, বলো তো প্রকৃতই তুমি কোন ক্লাবের মেম্বার? আমার মনে হচ্ছে আজ নিয়ে এই বছরে অন্তত চারবার তোমাকে মেডেল দিলাম চারটে বিভিন্ন ক্লাবের মেম্বার হিসেবে! তা ছাড়া উপরি বেস্ট প্লেয়ার মেডেল।”
কলেজ জীবন:
তাঁর ইচ্ছা ছিল সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হওয়ার, কারণ, সেখানে খেলাধুলার ভালো সুযোগ ছিল। কিন্তু বাবার নির্দেশে তাকে শিয়ালদহের রিপন কলেজে (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) ভর্তি হতে হয়। এখানে ভর্তি হয়ে তার জীবনে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। তিনি প্রমথনাথ বিশী, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসুর মতো বিখ্যাত অধ্যাপকদের সান্নিধ্য লাভ করেন।
তিনি মূলত স্বশিক্ষিত ছিলেন এবং জীবনানন্দ দাশ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি সাহিত্যিকদের রচনা অধ্যয়ন করে নিজের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছিলেন। কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ও নাট্যচর্চাই ছিল তাঁর প্রকৃত শিক্ষাগুরু।
পড়াশোনার বিমুখতা ও অ্যাডভেঞ্চার:
যদিও তিনি খেলাধুলার সুযোগ পাননি, তবে তাঁর মধ্যে অ্যাডভেঞ্চারের নেশা ছিল প্রবল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি বাড়িতে কিছু না জানিয়ে এয়ারফোর্সে যোগ দিতে পাঞ্জাবে ট্রেনিং নিতে চলে গিয়েছিলেন। বাবার চেষ্টায় তাঁকে ফিরিয়ে আনা হলেও, তিনি আবার দিল্লিতে ওয়ারলেস হেডকোয়ার্টার্সে চাকরি নিয়ে পালিয়ে যান। একই সময় দিল্লির রাজপথ ’৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল। দেখলেন সাধারণ মানুষ হাসিমুখে জেলে ঢুকছে। তাঁর কথায়, “এই সময় মনে প্রশ্ন এল, যে ইংরেজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এতগুলো মানুষ মরছে, সেই জাতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছি আমি? কোনটা ঠিক?” আবার ফিরে এলেন কলকাতায়।
কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় জীবন :
অভিনয়ে আগ্রহ:
ছোটবেলা থেকেই নাটকের প্রতি তার আগ্রহ ছিল। স্কুলে পড়ার সময় বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করতেন। পরবর্তীকালে তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সক্রিয় সদস্য হন, যা তার অভিনয় শৈলীকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
১৯৫২ সালে তাঁর কন্যা তাপসীর জন্ম হয়। ৫২ সাল থেকেই তিনি সব দ্বিধা ঝেড়ে পেশাদার অভিনেতা হিসেবে বাংলা চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় করতে শুরু করেন। কালী বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন চলচ্চিত্র ও নাট্যজগতের একজন শক্তিমান ও কিংবদন্তি অভিনেতা, যিনি ১৯৫০ ও ১৯৬০ এর দশকে বাংলা চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। তাঁর অভিনয় ছিল সাবলীল, বাস্তবসম্মত এবং হৃদয়গ্রাহী। তিনি চরিত্রকে গভীরভাবে উপলব্ধি করে তা পর্দায় ফুটিয়ে তুলতেন, যার ফলে দর্শক তার অভিনয়ের সঙ্গে সহজেই একাত্ম হতে পারতেন।
মহেন্দ্র গুপ্তর পরিচালনায় ‘শতবর্ষ আগে’, এর পর ‘টিপু সুলতান’, ‘স্বর্গ হতে বড়’ নাটকেও তিনি কাজ করেন। ‘টিপু সুলতান’ নাটকের পঞ্চাশ রজনীতে পুরস্কার হিসেবে সকলের সঙ্গে পেলেন একটি হাতঘড়ি।
একদিন স্টারে অভিনয় করতে যাবেন বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় ‘রশিদ আলি দিবস’-এর মিটিং দেখে সব ভুলে নেমে পড়লেন বাস থেকে। মিশে গেলেন অগণিত জনতার মিছিলে। নাটক করতে আর যাওয়া হল না। এর খেসারত হিসেবে জুটল মহেন্দ্র গুপ্তর বকুনি। একশো রজনীতে পুরস্কৃতের তালিকা থেকে বাদ পড়ল তাঁর নাম। কারণ জানতে চেয়ে হাজির হলেন মহেন্দ্র গুপ্তর সামনে। তিনি জানালেন, সেই দিনের অনুপস্থিতির শাস্তি হিসেবেই এই সিদ্ধান্ত। মেনে নিতে পারলেন না কালীবাবু। নাটক শুরুর আগেই মেকআপ তুলে বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়। মন খারাপ, ভাবছেন, “যারা নাটকে দামি দামি কথা সাজায়, রশিদ আলির ঘটনার গুরুত্ব তাদের কাছে নেই কেন?”
আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে আমরা এই মহান অভিনেতাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। তাঁর অবদান বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র:
পথের পাঁচালী (১৯৫৫):
সত্যজিৎ রায়ের এই কালজয়ী ছবিতে তিনি হরিহর রায়ের চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যান। তাঁর অভিনয় এই ছবিতে এক অবিস্মরণীয় মাত্রা যোগ করেছিল।
অপরাজিত (১৯৫৬):
পথের পাঁচালীর সিক্যুয়েল এই ছবিতেও তিনি তাঁর অসাধারণ অভিনয় প্রতিভা দেখিয়েছেন।
পরশ পাথর (১৯৫৮):
সত্যজিৎ রায়ের এই ছবিতে তাঁর কমেডি টাইমিং এবং সূক্ষ্ম অভিনয় ক্ষমতা বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছিল।
জলসাঘর (১৯৫৮):
এই ছবিতে তাঁর অভিনয় ছিল ব্যতিক্রমী এবং স্মরণীয়।
এছাড়া তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য কিছু চলচ্চিত্র হল ‘অশনি সংকেত’ (১৯৭৩) ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ (১৯৭৯)
কালী বন্দ্যোপাধ্যায় শুধুমাত্র সত্যজিৎ রায়ের ছবিতেই নন, বরং অন্যান্য অনেক জনপ্রিয় পরিচালকের সঙ্গেও কাজ করেছেন এবং বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে নিজের বহুমুখী প্রতিভা প্রমাণ করেছেন। তিনি কমেডি থেকে শুরু করে সিরিয়াস ড্রামা, সব ধরনের চরিত্রেই সাবলীল ছিলেন।
নাটক ও চলচ্চিত্রে অবদান:
কালী বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনয় জীবনে প্রায় দেড়শো ছবিতে কাজ করেছেন। নাটক করেছেন একত্রিশটি। বাংলা থিয়েটারে তাঁর অভিনয়ও স্মরণীয়, বিশেষত বহুরূপী নাট্যদলের সাথে কাজ। মাধবী মুখ্যোপাধ্যায় মনে করেন, “কালী বন্দ্যোপাধ্যায় একজন জাতশিল্পী ছিলেন। মঞ্চ আর সিনেমা দু’ধরনের অভিনয়েই তিনি ছিলেন অতি দক্ষ। শিল্পীসুলভ এক ধরনের পাগলামি ওঁকে তাড়িয়ে বেড়াত।” ঋত্বিকপত্নী সুরমা ঘটকের ভাবনায় “তাঁকে ছাড়া ‘অযান্ত্রিক’, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ আর ‘কত অজানারে’র মতো ছবি সম্ভবই হত না।” তপন সিংহ বলেছেন, “দুঃখ এটাই যে, ওঁকে ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারল না টালিগঞ্জ।” উত্তমকুমারের অভিমত হলো, “সৌমিত্র নয়, আমার আসল প্রতিদ্বন্দ্বী কালী বন্দ্যোপাধ্যায়।” আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “কালী ব্যানার্জি বাংলা সিনেমার প্রথম ব্যতিক্রমী নায়ক। সত্যিকারের মানুষকে অভিনয়ের মধ্যে ব্যক্ত করার আগ্রহটা সব অভিনেতার থাকে না।”
পুরস্কার:
স্কুলে থাকতেই তিনি নাটক করতে শুরু করেন। এসময় হঠাৎই একদিন দক্ষিণ কলকাতার শৌখিন অভিনেতা বিদ্যুৎ বসুর ডাকে ‘কেদার রায়’ নাটকে কার্ভালো-র চরিত্রে অভিনয় করে প্রথম রজনীতেই পুরস্কার পেলেন। তার পরই বন্ধুদের মধ্যে তাঁর নাম হয়ে গেল, ‘কার্ভালো কালী’।
পরবর্তীকালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৮১) ও পদ্মশ্রী (১৯৮৪, মরণোত্তর) সহ বহু সম্মানে ভূষিত। স্বভাবজাত অভিনয়ের জন্য পরিচিত ছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী (১৯৫৫)-তে হরিহর চরিত্রে অভিনয় করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি পান।
মৃত্যু :
জীবনের শেষ ছবি ‘তান্ত্রিক’-এ অভিনয় করতে গিয়ে বৃষ্টিতে খুব ভিজতে হয়েছিল। তা থেকেই তিনি ব্রঙ্কো-নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও ৫ জুলাই ১৯৯৩ তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর আকস্মিক প্রয়াণ বাংলা চলচ্চিত্র জগতের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি ছিল। তিনি বেঁচে থাকলে বাংলা চলচ্চিত্র আরও অনেক মূল্যবান কাজ পেত।
আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে আমরা এই মহান অভিনেতাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। তাঁর অবদান বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
----------xx--------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন