ভারতের জাতীয় প্রতীকের নকশাকার

ভারতের জাতীয় প্রতীকের নকশাকার কে ছিলেন?

Designer of the National Emblem of India

ভারতের জাতীয় প্রতীক :

ভারতের ‘জাতীয় প্রতীক’ হল অশোক স্তম্ভের শীর্ষভাগের অংশ ‘সিংহচতুর্মুখ’, যা সাধারণভাবে ‘অশোক স্তম্ভ’ নামে পরিচিত। সারনাথের অশোক স্তম্ভ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই প্রতীকটি আঁকা হয়েছিল। এই নকশাটির ইতিহাস ও নির্মাণ সম্পর্কে আমরা অধিকাংশ ভারতীয়ই প্রায় কিছুই জানিনা। আসুন জেনে নিই, কখন, কোন প্রসঙ্গে, কারা ভারতের এই ঐতিহ্যবাহী ‘জাতীয় প্রতীক’ অঙ্কন করেছিলেন।

কে নকশা করেছিলেন?

ভারতের জাতীয় প্রতীকের নকশাকার হলেন শিল্পী দিননাথ ভার্গব (Dinanath Bhargava)। তিনি তখন ‘বোম্বে আর্ট স্কুলে’র (জে. জে. স্কুল অফ আর্ট) একজন ছাত্র। এই কাজে তাঁকে সহায়তা করেছিলেন তাঁর শিক্ষক, তৎকালীন ভারতের একজন বিখ্যাত বাঙালি চিত্রকর, নন্দলাল বসু।

কখন গৃহীত হয়েছিল?

ভারতের জাতীয় প্রতীক ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০-এ (প্রজাতন্ত্র দিবস) সরকারিভাবে গ্রহণ করা হয়।

ভারতের জাতীয় প্রতীকের বৈশিষ্ট্য :

ভারতের জাতীয় প্রতীকের কেন্দ্রে আছে চারটি সিংহ, যেগুলো একটি বৃত্তাকার শীলা ফলকের উপর দাঁড়িয়ে আছে। শিলা ফলকটির মধ্যে নিচের দিকে রয়েছে একটি ধর্মচক্র, একটি ছুটন্ত ঘোড়া ও একটি ষাঁড়ের মূর্তি। 
1. প্রেরণা : প্রতীকটি ‘অশোকের সারনাথ স্তম্ভের শীর্ষভাগ’ থেকে নেওয়া হয়েছে, যেখানে চারটি সিংহ পিঠে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে (মৌর্য সম্রাট অশোক খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে এটি নির্মাণ করেছিলেন)।
2. রূপান্তর : মূল স্তম্ভে চারটি এশিয়ান সিংহ দেখা গেলেও প্রতীকে শুধু তিনটি সিংহ দৃশ্যমান (চতুর্থটি পিছন দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে )। শক্তি, সাহস, আত্মবিশ্বাস ও গর্বের প্রতীক।
3. ধর্মচক্র বা অশোক চক্র : ভারতের জাতীয় প্রতীকের নিচের অংশে রয়েছে একটি ধর্মচক্র (অশোক চক্র)। তার দু'পাশে রয়েছে যথাক্রমে একটি ছুটন্ত ঘোড়া ও ষাঁড়ের মূর্তি। হিন্দু পুরাণ মতে, এগুলি কৃষি-সম্পদের প্রতীক।
4. নীতিবাক্য: একেবারে নীচে দেবনাগরী লিপিতে লেখা আছে ‘সত্যমেব জয়তে’। এই নীতি বাক্যটি মুণ্ডক উপনিষদ থেকে নেওয়া, যার অর্থ হল ‘সত্যই জয়ী হয়’।
5. রঙ : সরকারিভাবে ব্যবহারে সাধারণত নীল সাদা বা মোনোক্রোম (একরঙা) রূপে দেখা যায়। তবে বর্তমানে এর রঙিন সংস্করণে কমলা সবুজ ও নীল রংয়ের ব্যবহার করা হয়।
6. ব্যবহার বা গুরুত্ব : ভারতের জাতীয় প্রতীকটি ভারতের সংবিধান, সরকারি নথি, মুদ্রা ও গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্থাপনায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

মূল প্রতীকের সঙ্গে জাতীয় প্রতীকের পার্থক্য :

  • সম্রাট অশোকের তৈরী মূল সারনাথ স্তম্ভে চারটি সিংহ আছে। কিন্তু জাতীয় প্রতীকে শুধুমাত্র তিনটি সিংহ দৃশ্যমান। চতুর্থটি কল্পনা করা হয় যে আছে। কিন্তু বাস্তবে তাকে দেখা যায় না।
  • মূল স্তম্ভে ধর্মচক্রের নিচে একটি ঘোড়া ও একটি ষাঁড় আছে। কিন্তু জাতীয় প্রতীকে শুধু ষাঁড় ও গড়ুর দেখা যায়।

ভারতের জাতীয় প্রতীক তৈরীর ইতিহাস :

১৯৪২ সালের ভারতছাড়ো আন্দোলনের ব্যাপকতা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক কালে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের কার্যকলাপ, ১৯৪৬ সালের নৌ বিদ্রোহ ইত্যাদি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ফলে একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে খুব তাড়াতাড়ি ব্রিটিশ সরকার ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য হবে। সুতরাং শুরু হয়ে যায়, স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার তাগিদ।

এদিকে কংগ্রেসের লখনৌ অধিবেশনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু গান্ধীজীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন নন্দলাল বসুকে। ততদিনে নন্দলাল বসু একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। এর পর ১৯৩৮ সালে জাতীয় কংগ্রেসের হরিপুরা সম্মেলনের সভা সাজানোর দায়িত্ব পান নন্দলাল বসু। সাফল্যের সঙ্গে এই কাজ করার ফলে একজন চিত্রশিল্পী হিসাবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতে। 

স্বাভাবিকভাবেই ১৯৪৬ সালে ভারতের সংবিধান চিত্রণের দায়িত্ব পড়ে তাঁর উপর। এ ব্যাপারে ১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একটি সভায় সভাপতিত্ব করার দায়িত্ব পান সচ্চিদানন্দ সিনহা। তিনি তাঁর নেতৃত্বে নন্দলাল বসু সহ ২০৫ জন সদস্যের একটি কমিটি গড়ে গড়ে তোলেন। এই সভায় ঠিক হয়, নন্দলাল বসুর নেতৃত্বে এই কমিটির সদস্য রাম মনোহর সিনহা, দীননাথ ভার্গব, বিনায়ক শিবরাম মাসোজি, এ পেরুমল, নিবেদিতা বসু, অমলা সরকার, গৌরী ভঞ্জ, যমুনা সেন, বাণী পাটেল, জগদীশ মিত্তাল, ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেব বর্মন, কৃপাল সিং সেখাওয়াত, সুচিত্রা নারায়ণ, এবং নিজ পুত্র বিশ্বরূপ বসু সহ কলাভবনের ছাত্র-ছাত্রীরা এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে সক্রিয় অংশ নেবেন।

নন্দলাল বসু ঠিক করেন, সংবিধানের প্রথম পাতায় সারনাথে অবস্থিত অশোক স্তম্ভের শীর্ষে থাকা সিংহচতুর্মুখকে অন্তর্ভুক্ত করবেন। সিংহ চতুর্মুখকে খুবই প্রাঞ্জল ও বাস্তবসম্মত করার জন্য তিনি দায়িত্ব দেন দিননাথ ভার্গব নামে তাঁর এক ২১ বছর বয়সী ছাত্রকে। জানা যায়, এই কাজটি নিখুঁতভাবে করার জন্য দিননাথ ভার্গব শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতার চিড়িখানা চিড়িয়াখানায় এসে প্রায় এক মাস ধরে সিংহের শারীরিক গঠন ও আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। এরপর ভার্গব তার আঁকা নকশাটি তিনি নন্দলাল বসুর কাছে জমা দেন। নন্দলাল বসু খুশি খুশি হন এবং এই ছবিটি সংবিধানের প্রথম পাতায় অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। এভাবেই নন্দলাল বসুর নেতৃত্বে শিল্পী দিননাথ ভার্গবের হাতে আঁকা সেদিনের সেই ‘সিংহচতুর্মুখ’-এর নকশাটিই হয়ে ওঠে বর্তমান ভারতের জাতীয় প্রতীক।

নন্দলাল বসু ও তাঁর দল ভারতের সংবিধানের মূল হস্তলিখিত কপির সজ্জায় এই নকশাটি এই প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস ও ভারতীয় সংস্কৃতি ফুটে ওঠে এই নকশায়। তিনটি কপি তৈরি হয়। ১৯৪৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর গণপরিষদ এই প্রতীকটি গ্রহণ করে। প্রেমনারায়ন রায়াদা ও বসন্ত বৈদ্যের ক্যালিগ্রাফিতে (হাতে লেখা) হিন্দি ও ইংরেজিতে লেখা ও চিত্রিত কপিগুলি আজও সংসদের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে বিশেষ হিলিয়ামযুক্ত আধারে সংরক্ষিত আছে।

উল্লেখ্য, দিননাথ ভার্গব মাত্র ৫০ টাকা পারিশ্রমিক  পেয়েছিলেন এই নকশার তৈরীর জন্য!

এই প্রতীক ভারতের ঐক্য, সততা ও শক্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।
---------xx--------- 

মন্তব্যসমূহ

🔰 ব্যক্তি অনুযায়ী তথ্য খুঁজুন : 🔍

আরও দেখান

🔰 তথ্য তালাশ : জনপ্রিয় ব্যক্তি ও বিষয়গুলো দেখুন:

উসেইন বোল্ট, ১০০ মিটার দৌড়ে রেকর্ড

প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ার-এর জন্মদিন

আন্তর্জাতিক সাইকেল দিবস

বিরসা মুন্ডার মৃত্যুদিন

মায়া অ্যাঞ্জেলু প্রয়াত হন

চে গেভারার জন্মদিন

মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা শিবাজীর রাজ্যভিষেক

প্রথম অস্কার পুরস্কার

তথ্য তালাশ : অনলাইন সংকলন

আলী হোসেন, লেখক,
তথ্য তালাশ
সুপ্রিয় পাঠক,

তথ্য তালাশ-এর অনলাইন সংকলনে আপনাকে স্বাগত। 

প্রতিদিন, প্রতি নিয়ত বিশ্বজুড়ে ঘটে চলেছে নানান ঘটনা। কিছু বিখ্যাত, কিছু অখ্যাত, আবার কিছু কুখ্যাতও। এই সব হরেক ঘটনার মধ্যে থাকে এমন কিছু ঘটনা, যা মানুষ মনে রাখতে চায়, চায় স্মরণ করতে।

তথ্য তালাশ সেই লক্ষ্য নিয়েই তৈরি। যেহেতু এটি ডিজিটাল ফরম্যাটে তৈরি, তাই যখনই প্রয়োজন পড়বে, আপনার হাতের মোবাইলে হাত রাখলেই আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের মত সামনে হাজির হবে তথ্য তালাশ

আপনি কি পড়তে চান এই সংকলনটি! ক্লিক করুন এখানে