প্রথম রাজধানী এক্সপ্রেস ট্রেনের উদ্বোধন
প্রথম রাজধানী এক্সপ্রেস ট্রেনের উদ্বোধন :
Inauguration of the first Rajdhani Express train
১৯৬৯ সালের ১ মার্চ। ভারতে প্রথম রাজধানী এক্সপ্রেসের উদ্বোধন হয়। এই দিন বিকেলে ৫:৩০ মিনিটে দিল্লি থেকে হাওড়ার উদ্দেশ্যে দেশের প্রথম রাজধানী এক্সপ্রেস যাত্রা শুরু করে। ট্রেনটি ১৭ ঘণ্টা ২০ মিনিট সময় নিয়ে পরের দিন সকাল ১০:৫০ মিনিটে হাওড়ায় পৌঁছে নজির সৃষ্টি করে। ফিরতি যাত্রায় ট্রেনটি ৩রা মার্চ, ১৯৬৯ তারিখে হাওড়া থেকে যাত্রা শুরু করে।উল্লেখ্য, ১৪৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পথে শিয়ালদা থেকে আরও একটি রাজধানী এক্সপ্রেস চালু হয় ২০০০ সালের ১ জুলাই।
রাজধানী এক্সপ্রেস উদ্বোধনের পটভূমি
১) লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ :
বাংলাকে বিভক্ত করে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে পঙ্গু করে দেয়ার উদ্দেশ্যে লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ আইন পাস ও কার্যকর করেন। এই আইন পাশের সাথে সাথে বাংলা জুড়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে ‘রাখি বন্ধন’ উৎসব পালনের সিদ্ধান্ত নেন। বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ রাখাই এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য ছিল।
২) বয়কট আন্দোলনের চাপ :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সাথে সারা বাংলায় শুরু হয় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের দুটি ধারা। এক কথায় যাকে বলা হয় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন। একটি ধারার নাম স্বদেশী এবং অন্যটির নাম বয়কট।
স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের ব্যাপকতার কারণে ব্রিটিশ সরকার দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
১) ১৯১১ সালের ১২ ই ডিসেম্বর ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়। উদ্দেশ্য বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রভাব থেকে রাজধানীকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেওয়া।
২) একই বছর এবং একই দিনে বঙ্গভঙ্গ রদ করা। অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত বাতিল করা।
৩) রাজধানী বদল :
১৭৭২ সাল থেকে কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হিসেবে মর্যাদা পেতো। কিন্তু দিল্লিতে রাজধানী সরে যাবার পর কলকাতার গুরুত্ব কিছুটা কমে যায়। নতুন ও পুরাতন রাজধানীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা মোটেই সহজ ছিল না। ফলে কলকাতা ও দিল্লির মধ্যে দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
৪) পুরনো রাজধানীর গুরুত্ব :
স্বাধীন ভারতের ক্ষেত্রেও এই গুরুত্ব একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। সেদিকটা মাথায় রেখেই ১৯৬৯-৭০ সালের রেল বাজেটে একটি দ্রুতগামী ট্রেন চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উদ্দেশ্য পুরনো এবং নতুন রাজধানীর মধ্যে দ্রুত যোগাযোগ স্থাপন করা।
মূলত এই উদ্দেশ্যেই এক মার্চ ১৯৬৯ সালের বিকালে দিল্লি থেকে হাওড়ার উদ্দেশ্যে দেশের প্রথম রাজধানী এক্সপ্রেস যাত্রা শুরু করে। ১৭ ঘণ্টা কুড়ি মিনিট সময় ব্যয় করে অবশেষে হাওড়ায় পৌঁছায়।
রাজধানী এক্সপ্রেস-এর ইতিহাস :
১) ট্রেনের বৈশিষ্ট্য ও পরিষেবা
গতির রেকর্ড:
প্রথম রাজধানী এক্সপ্রেসটি তার সময়কালে ভারতীয় রেলের ইতিহাসে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। এটি ১৪৫০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে মাত্র ১৭ ঘন্টা ২০ মিনিটে, যা আগের ট্রেনগুলোর ২৪ ঘন্টারও বেশি সময়ের তুলনায় অনেক কম ছিল। ট্রেনটির সর্বোচ্চ গতি ছিল প্রতি ঘন্টায় ১২০ কিলোমিটার।
কোচ এবং কাঠামো:
প্রাথমিকভাবে এই ট্রেনে মোট নয়টি কোচ ছিল, যার মধ্যে একটি ডাইনিং কার, একটি ফার্স্ট ক্লাস এসি কোচ, পাঁচটি এসি চেয়ার কার এবং দুটি জেনারেটর/পাওয়ার কার ছিল।
ভাড়া:
১৯৬৯ সালে ফার্স্ট ক্লাস এসি কোচের ভাড়া ছিল ২৮০ টাকা এবং এসি চেয়ার কারের ভাড়া ছিল ৯০ টাকা।
বিশেষ আকর্ষণ:
ট্রেনটিতে যাত্রীদের জন্য বিলাসবহুল পরিষেবা ছিল, যেমন - সুস্বাদু খাবার পরিবেশন, লাউঞ্জ কারে ম্যাগাজিন এবং খবরের কাগজ পড়ার ব্যবস্থা। খাবারের মেনু তৈরি করতেন ক্যাটারিং ম্যানেজার নিজে।
লোগো ও টিকিট:
তখনকার টিকিটে হাওড়া ব্রিজ এবং কুতুব মিনারের ছবিসহ একটি তীর চিহ্ন ছিল, যা যাত্রাপথের দিক নির্দেশ করত। টিকিট ছিল মোটা কাগজের তৈরি এবং যাত্রীর নাম, বার্থ নম্বর ও অন্যান্য তথ্য তাতে লেখা থাকত।
চালক ও গার্ড:
প্রথম হাওড়া-নয়াদিল্লি রাজধানী এক্সপ্রেসের চালক ছিলেন জি এল টোচার এবং গার্ড ছিলেন এস ও লেভি।
২) বিবর্তন ও বর্তমান অবস্থা
I) আধুনিকীকরণ:
সময়ের সাথে সাথে রাজধানী এক্সপ্রেসে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ১৯৮৩ সালে এসি চেয়ার কারের পরিবর্তে টু-টিয়ার এবং ১৯৯৩ সালে থ্রি-টিয়ার এসি কোচ যুক্ত করা হয়।
II) নতুন রুটে প্রসার:
হাওড়া-নয়াদিল্লি রুটের সাফল্যের পর ১৯৭২ সালে মুম্বাই থেকে দ্বিতীয় রাজধানী এক্সপ্রেস চালু হয়। বর্তমানে, সারা দেশে বিভিন্ন রুটে ২৪টিরও বেশি রাজধানী এক্সপ্রেস ট্রেন চলাচল করে, যা দেশের বিভিন্ন রাজ্যের রাজধানীকে নয়াদিল্লির সাথে সংযুক্ত করে।
III) শিয়ালদহ রাজধানী এক্সপ্রেস:
২০০০ সালের ১ জুলাই শিয়ালদহ থেকে নয়াদিল্লির উদ্দেশ্যে আরেকটি রাজধানী এক্সপ্রেস চালু হয়, যা তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে উদ্বোধন হয়েছিল।
ইতিহাস সংরক্ষণ :
ক) চলমান জাদুঘর :
এই গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাসকে ধরে রাখা এবং ২০০০ সালের ১ জুলাই চালু হওয়া শিয়ালদা-রাজধানী এক্সপ্রেস-এর গৌরবময় ২৫ বছর উদযাপন উপলক্ষে শিয়ালদা-রাজধানী এক্সপ্রেসের ফাস্ট এসি কোচকে বিশেষভাবে সাজিয়ে চলমান জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। রেলগাড়িতে স্থাপিত এই জাদুঘরের নাম দেয়া হয়েছে ‘টেল অফ টু ক্যাপিটালস’ (Tale of two Capital)। এই জাদুঘরে অলংকরণ ও বিবরণের মাধ্যমে ভারতের দুই রাজধানীর (কলকাতা ও দিল্লী) ঐতিহ্য ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে।
খ) জাদুঘরের বিষয় :
এই জাদুঘরে উপস্থাপিত হয়েছে কলকাতা ও দিল্লির নগর নির্মাণের প্রেক্ষাপট এবং ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল গভর্মেন্ট হাউস রাইটার্স বিল্ডিং জাদুঘর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল এর ইতিহাস। এখানে জায়গা পেয়েছে হারবার্ট বেকার, আধুনিক দিল্লির রূপকার এডউইন লুটিয়েন্স, ন্যাশনাল মিউজিয়ামের প্রসঙ্গ। সেই সঙ্গে জায়গা পেয়েছে বাংলার দুর্গাপুজো, রামমোহন রায়, স্বামী বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত মনীষীদের কথা।
গ) জাদুঘরের উদ্বোধন :
১ জুলাই ২০২৫ শিয়ালদা থেকে এই সজ্জিত চলমান জাদুঘর যাত্রা শুরু করে। এই যাত্রায় যাত্রীদের উপহার হিসাবে দেওয়া হয় গোলাপ ফুল এবং ডিনারে দেওয়া হয় রসগোল্লা।
মন্তব্য :
প্রথম রাজধানী এক্সপ্রেস ছিল ভারতীয় রেলের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা দ্রুতগতির এবং বিলাসবহুল ভ্রমণের এক নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছিল।
--------xx-------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন