রতন থিয়াম প্রয়াত হন
Ratan Thiyam passes away
২০২৫ সালের ২৩ জুলাই। রতন থিয়াম প্রয়াত হন। রতন থিয়াম হলেন একজন কিংবদন্তি ভারতীয় নাট্যকার ও থিয়েটার পরিচালক। ‘থিয়েটার অফ রুটস’ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সূত্রধর হিসেবে তিনি বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।
১৯ ৪৮ সালের ২০ শে জানুয়ারি তিনি মনিপুর রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে নয়া দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
আজ ৭৭ বছর বয়সে মনিপুর রাজ্যের ইন্ফল পশ্চিম জেলার অন্তর্গত ল্যাম্ফেলপাত উপশহরে প্রয়াত হয়েছেন।
মনিপুরী নাট্য জগতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন রতন থিয়াম। তিনি প্রাদেশিক গন্ডি পেরিয়ে ভারতীয় নাটকে তাৎপর্যপূর্ণ ছাপ রেখে গিয়েছেন। তিনি একদিকে যেমন একাধিক নাটক লিখেছেন, সেই সঙ্গে বহু নাটকে পরিচালকের ভূমিকায় সাফল্যের চূড়া ছুঁয়েছেন।
প্রাচীন রীতিকে তাঁর নাটকে আধুনিকতার মোড়কে তুলে ধরে তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। ভারতের বিভিন্ন ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে আধুনিকতার ছাঁচে ফেলে দারুণভাবে নাট্য প্রেমীদের কাছে তুলে ধরেছেন।
‘চক্রব্যূহ’, ‘ঋতুসংহারম’ ইত্যাদির মত নাট্যনির্মাণ করে তিনি খ্যাতি লাভ করেছেন। তাঁর নাটক ‘অবহেলিত’ এর মাধ্যমে উত্তর পূর্বের রাজ্য মনিপুরের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে গোটা ভারতে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর নির্দেশিত ‘উত্তর প্রিয়দর্শী’, ‘হে নুংশিবি পৃথিবী’, ‘চিংলোঁ মাপান তাম্পক আমা’র মত নাটক থিয়েটারের দর্শকদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
১৯৭০ এর দশকে শুরু হওয়া ‘থিয়েটার অফ রুটস’ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নাট্য জগতে বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি অল্প সময়ের জন্য ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার সভাপতি ছিলেন। এছাড়া তিনি সংগীত নাটক একাডেমীর ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।
১৯৮৪ সালে ইন্দো-গ্রিক বন্ধুত্ব পুরস্কার পান গ্রিক সরকারের কাছ থেকে। ১৯৮৭ সালে পান সংগীত নাটক একাডেমী পুরস্কার। এই বছরই এডিনবার্গ আন্তর্জাতিক উৎসব থেকে পেয়েছিলেন ‘ফ্রিঞ্জ ফার্স্টস পুরস্কার’। ১৯৮৯ সালে তিনি পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। ২০১৩ সালে পেয়েছিলেন ‘ভূপেন হাজারিকা ফাউন্ডেশন পুরস্কার’। সারা জীবনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিলিয়ে প্রায় দশটি পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছিলেন।
তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সোশ্যাল মিডিয়ার একাউন্টে লিখেছেন,
“মণিপুরি থিয়েটারের আইকন কিংবদন্তি রতন থিয়ামের মৃত্যুতে আমি শোকাহত। গোটা বিশ্বের দরবারে মনিপুরী থিয়েটারকে পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি।”
তাঁর মৃত্যুতে পশ্চিমবাংলার বিশিষ্ট নাট্যকার, নাট্যনির্দেশক ও অভিনেতা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। বিশিষ্ট নাট্যনির্দেশক আশিষ চট্টোপাধ্যায় সহ কয়েকজন বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব এই সময় সংবাদপত্রকে তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। আশিষ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন,
“তার নাট্যশৈলী অনুসরণ করে নাটককে আরো বাস্তবমুখী করার প্রয়াস অনেকটাই ধাক্কা খাবে নিঃসন্দেহে। রবীন্দ্রনাথের নাটককে নতুন আঙ্গিকে মঞ্চস্থ করে তিনি যে পথ উন্মোচিত করে গিয়েছেন তা বাংলা তথা বাঙালিরা ভুলবে কেমন করে? গভীর শূন্যস্থান তৈরি হলো।”
নাট্যকার চন্দন সেন রতন থিয়ামের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে গিয়ে বলেন,
“এমন কিংবদন্তির চলে যাওয়ায় শুধু এ দেশ নয় বিশ্বের দরবারেও শূন্য হয়ে গেল। মনিপুর বাংলা বা এদেশ নয় পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই তিনি তিলে তিলে জেলে ছিলেন থিয়েটারের দীপশিখা।... বলা ভালো, এদেশের বহু নাট্য প্রতিবন্ধকতা কাটাতে তিনি সর্বপ্রথম এগিয়ে এসেছিলেন।”
অভিনেতা চন্দন সেন বলেছেন,
“থিয়েটার কে কোন নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিয়েছেন রতন থিয়াম, যা কল্পনারও অতীত। এক ইতিহাসও গড়েছেন বলা যায়। ভাবা যায়, আদিবাসীদের কথা এখন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এদেশেরি নাটকের মঞ্চে! কেউ ভাবতে পেরেছিলেন, চাষী বা দিনমজুর মঞ্চে দাঁড়িয়ে আঙুল তুলছেন সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে? উনি শুধু বিনোদনের জন্য নাটক করেননি, বরং অরাজকতার বিরুদ্ধেই বারবার সোচ্চার হয়েছেন।”
অভিনেতা মেঘনাদ ভট্টাচার্যের কথায়,
“তিনি বিশ্বাস করতেন থিয়েটার হল শিকড়। তিনি তার রসদ আহরণ করতেন প্রাচীন গ্রিক, সংস্কৃত ও জাপানি নাট্য রীতি থেকে। কিন্তু বপন করতেন তার নিজ কর্মভূমি মণিপুরে। তিনি যেন ছিলেন এক চলমান ভাস্কর্য।”
রতন থিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে কোভিড পরবর্তী বিভিন্ন স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। শেষমেষ ২৩ জুলাই বুধবার ভোর রাতে মনিপুরের ইম্ফলের রিমস (রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সাইন্সেস) হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন