রামকিঙ্কর বেইজ-এর প্রয়াণ দিবস
রামকিঙ্কর বেইজ-এর প্রয়াণ দিবস :
Death anniversary of Ramkinkar Baez
১৯৮০ সালের ২ আগস্ট। রামকিঙ্কর বেইজ ৭৪ বছর বয়সে কলকাতায় প্রয়াত হন। আধুনিক ভারতীয় ভাস্কর্য কলার অন্যতম অগ্রপ্রথিক ছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালে পান পদ্য ভূষণ সম্মান।রামকিঙ্কর বেইজ (Ramkinkar Baij, 1906–1980) ছিলেন ভারতীয় শিল্পকলার ইতিহাসে এক কিংবদন্তি আধুনিক ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্পী, যিনি ভারতীয় আধুনিক শিল্প আন্দোলনের অগ্রদূত হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর শিল্পকর্ম প্রথাগত সীমানা ভেঙে স্থানীয় সংস্কৃতি, আদিবাসী জীবন ও শক্তিমান অভিব্যক্তিকে আন্তর্জাতিক আধুনিকতার ভাষায় রূপ দিয়েছিল।
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন:
জন্ম: ২৬ মে, ১৯০৬, বাঁকুড়া জেলার (পশ্চিমবঙ্গ) জয়পুর গ্রামে এক দরিদ্র কামার (বাঢ়ৈ) পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
পরিবার: পিতা কর্তারাম বেইজ, মাতা হীরাদেবী। প্রাথমিক নাম ছিল ‘রামকিঙ্কর’ (রাম-কৃষ্ণের সংমিশ্রণ), পরে নিজেই ‘বেইজ’ (কামার) উপাধি যোগ করেন।
শৈশব: গ্রামীণ ও আদিবাসী (সাঁওতাল) সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠা। মাটির কাজ, পটচিত্র অঙ্কন ও স্থানীয় কারুশিল্পের প্রতি প্রাকৃতিক আকর্ষণ ছিল।
প্রাথমিক শিক্ষা:
স্থানীয় স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা। শিল্পের প্রতি প্রবল আগ্রহে ১৯২৫ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্ট (বর্তমান গভর্নমেন্ট কলেজ অফ আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফট)-এ ভর্তি হন। সেখানে নন্দলাল বসু, মুকুল দে প্রমুখের কাছে প্রশিক্ষণ লাভ করেন। তাঁর প্রতিভা তাড়াতাড়িই নন্দলাল বসুর নজর কাড়ে।
শান্তিনিকেতনে যুগান্তকারী যাত্রা:
১৯২৭ সালে নন্দলাল বসুর আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনের কলাভবনে যোগ দেন ছাত্র ও পরে শিক্ষক হিসেবে। শান্তিনিকেতনই হয়ে ওঠে তাঁর সৃজনশীলতার চিরস্থায়ী কেন্দ্র। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ, মুক্ত বাতাস, আদিবাসী (সাঁওতাল) জনজীবন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দর্শন তার শিল্পচিন্তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
কলাভবনে তিনি আজীবন শিক্ষকতা করেন (১৯২৭-১৯৭০) এবং অসংখ্য প্রথিতযশা শিল্পী গড়ে তোলেন (যেমন: গণেশ পাইন, সোমনাথ হোর, ধর্মনারায়ণ দাশগুপ্ত, কে.জি. সুব্রমণ্যন)।
শিল্পকর্মের বৈশিষ্ট্য ও বৈপ্লবিক অবদান:
ক) ভাস্কর্যেই যুগান্তর:
১) বিপুল আকার ও স্থাপত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি:
রামকিঙ্কর প্রথম ভারতীয় ভাস্কর যিনি বড় আকারের (মনুমেন্টাল) স্থাপনাযোগ্য ভাস্কর্য তৈরি করলেন, যা প্রকৃতির সাথে সংলগ্ন হয়ে শক্তি ও গতি প্রকাশ করে।
২) অপ্রথাগত উপকরণের ব্যবহার:
তিনি প্রথাগত ব্রোঞ্জ বা মার্বেলের বদলে ব্যবহার করলেন সিমেন্ট, কংক্রিট, পাথর কুচি, লোহার রড, এমনকি স্থানীয় কাঁকর-পাথর ও বালি। এটি ছিল এক সাহসী বিপ্লব, যা তার শিল্পকে গণতান্ত্রিক ও প্রাণবন্ত করে তুলেছিল।
৩) গতিশীলতা ও শক্তির প্রকাশ:
তার ভাস্কর্যে মানবদেহের অঙ্গভঙ্গিতে অসম্ভব গতি, শক্তি, রূক্ষতা এবং প্রাণশক্তির উদ্দাম প্রকাশ ঘটেছে।
৪) আদিবাসী জীবন ও সাধারণ মানুষের প্রতীক:
তাঁর কাজের কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল শান্তিনিকেতনের পার্শ্ববর্তী সাঁওতাল আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবন। তিনি তাদের শ্রম, উৎসব, সংগ্রাম ও সহজ-সরল অস্তিত্বকে মহিমান্বিত করেছিলেন। সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, কৃষক তার শিল্পের নায়ক।
৫) প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে সম্পৃক্ততা:
তাঁর ভাস্কর্যগুলো কোনো গ্যালারির জন্য নয়, শান্তিনিকেতনের খোলা প্রান্তরে, গাছপালার মধ্যে স্থাপনের জন্য তৈরি। এগুলো প্রকৃতিরই অংশ হয়ে আছে।
খ) অমর ভাস্কর্য:
১) সাঁওতাল পরিবার (Santhal Family, 1938):
ভারতীয় আধুনিক ভাস্কর্যের মাইলফলক। একটি সাঁওতাল পরিবারের পথ চলার গতিময় মূর্তি। (শান্তিনিকেতন)
২) সুজাতা (Sujata, 1938):
বুদ্ধকে খিচুড়ি নিবেদনকারী সুজাতার মূর্তি। (শান্তিনিকেতন)
৩) ল্যামাসাস (Harvesters, 1943):
ফসল কাটার দৃশ্য। (শান্তিনিকেতন)
৪) মিল চালানোর কাল্পনিক চিত্র (The Mill Call, 1956):
শ্রমিকের আন্দোলন ও সংগ্রামের প্রতীক। (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হাউসের সামনে)।
এছাড়া গান্ধীর মূর্তি (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়), রবীন্দ্রনাথের মূর্তি (নয়াদিল্লি), অমৃতা শেরগিলের প্রতিকৃতি ইত্যাদি।
গ) চিত্রকলায় স্বকীয়তা:
১) অভিব্যক্তিবাদী রীতির ধারক:
তার চিত্রকলায় (তেলরঙ, জলরঙ, প্যাস্টেল, স্কেচ) তীব্র রঙের ব্যবহার, বাঁকা রেখা, রূক্ষ ব্রাশস্ট্রোক এবং শক্তিমান রূপায়ণে অভিব্যক্তিবাদের ছাপ স্পষ্ট।
২) বিষয়বস্তু:
সাঁওতাল জীবন, গ্রামীণ দৃশ্য, প্রতিকৃতি (স্ব-প্রতিকৃতি সহ), নগ্নচিত্র, নিসর্গ। তার ছবিতেও গতি ও শক্তির প্রকাশ প্রাধান্য পায়।
৩) স্বতন্ত্র পথ:
তিনি সমসাময়িক বঙ্গশিল্পী বা বোম্বাই প্রগ্রেসিভ গ্রুপের স্টাইল থেকে ভিন্ন, নিজস্ব এক শক্তিশালী ভাষা গড়ে তুলেছিলেন।
ঘ) গ্রাফিক্স ও ড্রয়িং:
অসাধারণ রেখাচিত্র (ড্রয়িং) ও প্রিন্টমেকিং (এচিং, লিথোগ্রাফ)-এও দক্ষ ছিলেন। তার স্কেচবুকগুলো ছিল তার অবিরাম পর্যবেক্ষণ ও সৃজনশীলতার সাক্ষী।
ঙ) শিল্পদর্শন:
✔ শিল্পের জনমুখিতা:
শিল্পকে তিনি গণমানুষের কাছাকাছি নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তার ভাস্কর্য পাবলিক আর্টের আদর্শ উদাহরণ।
✔ স্থানীয়তাকে বিশ্বময় করা:
গ্রামীণ বাংলা, বিশেষ করে সাঁওতাল জীবন ও সংস্কৃতিকে তিনি আন্তর্জাতিক আধুনিক শিল্পভাষায় অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন।
✔ সরলতা ও শক্তির পূজারি:
তার শিল্পে আড়ম্বর বা সাজসজ্জা নেই, আছে কায়িক শ্রম, সংগ্রাম, আনন্দ ও জীবনীশক্তির রূক্ষ, স্পষ্ট ও শক্তিমান প্রকাশ।
✔ স্বাধীনতার পক্ষে:
শিল্পের বিষয় ও রূপে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাধীনচেতা, কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বা বাণিজ্যিক চাপে নয়।
স্বীকৃতি ও সম্মাননা (প্রধানত মরণোত্তর):
জীবদ্দশায় প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি কম পেলেও মৃত্যুর পর তার কাজের মূল্যায়ন ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
🙏 পদ্মভূষণ (১৯৭০): ভারত সরকারের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান।
🙏 দেশিকোত্তম (১৯৭০):** বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সম্মান।
🙏 দিল্লি ললিত কলা একাডেমির ফেলোশিপ (১৯৭০)।
🙏 তাঁর নামে কলকাতার রামকিঙ্কর বেইজ জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শান্তিনিকেতন, ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্ট (দিল্লি, মুম্বাই), কিরণ আর্ট মিউজিয়াম (দিল্লি) সহ বিশ্বের নামী সংগ্রহশালায় তার কাজ সংরক্ষিত।
🙏 ২০০৮ সালে শান্তিনিকেতনে তার ভাস্কর্য সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য বিশেষ কমপ্লেক্স নির্মিত হয়।
ব্যক্তিজীবন ও বৈশিষ্ট্য:
👉 তিনি ছিলেন অত্যন্ত সরল, অনাড়ম্বর, স্বাধীনচেতা ও নির্ভীক চরিত্রের মানুষ।
👉 জীবিকা ও স্বীকৃতির চেয়ে শিল্পসৃষ্টিই ছিল তার কাছে মুখ্য। গভীরভাবে মানবিক ও প্রকৃতিপ্রেমী ছিলেন।
👉 আজীবন অবিবাহিত ছিলেন। শান্তিনিকেতনের ক্যাম্পাসেই নিজের তৈরি স্টুডিও-ঘরে বাস করতেন।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার:
মৃত্যু: ২ আগস্ট, ১৯৮০ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে পরলোক গমন করেন।
উত্তরাধিকার:
রামকিঙ্কর বেইজ শুধু একজন শিল্পী নন, তিনি ভারতীয় শিল্পে এক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রতীক। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে আন্তর্জাতিক আধুনিকতা আর নিজস্ব স্থানীয় শিকড়ের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। তাঁর কাজ ভারতীয় শিল্পকে প্রাদেশিকতার গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ব দরবারে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি পরবর্তী প্রজন্মের অসংখ্য শিল্পীকে অনুপ্রাণিত করে গেছেন। তাঁর ভাস্কর্য শান্তিনিকেতনের ল্যান্ডমার্ক, যা আজও দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে। তাঁকে ‘ভারতীয় আধুনিক ভাস্কর্যের জনক’ এবং ‘আদিবাসী শিল্পের মহান রূপকার’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়।
আসলে রামকিঙ্কর বেইজ ছিলেন এক স্বতন্ত্র, বিপ্লবী ও অগ্রগামী শিল্পী, যিনি তাঁর অমর ভাস্কর্য ও চিত্রকলার মাধ্যমে ভারতীয় শিল্পে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন। স্থানীয় জীবন, আদিবাসী সংস্কৃতি এবং প্রকৃতির সাথে আন্তর্জাতিক আধুনিকতার এক অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি বিশ্বশিল্পের মানচিত্রে ভারতের স্থানকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছেন। তাঁর জীবন ও কর্ম ছিল সৃজনশীল স্বাধীনতা, শিল্পের জন্য নিষ্ঠা এবং সাধারণ মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
--------xx-------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন