মোহাম্মদ রফির প্রয়াণ দিবস
মোহাম্মদ রফির প্রয়াণ দিবস :
Mohammad Rafi's death anniversary
১৯৮০ সালের ৩১ জুলাই। মোহাম্মদ রফির প্রয়াণ দিবস। ১৯৮০ সালের আজকের দিনে ভারতের কিংবদন্তী প্লেব্যাক গায়ক মোহাম্মদ রফি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৫ বছর। তাঁর বহুমুখী কণ্ঠ এবং গানের বিশাল ভাণ্ডার তাঁকে ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। ১৯৬৭ সালে তিনি ভারত সরকারের কাছ থেকে পদ্মশ্রী সম্মান লাভ করেন। বাংলা, হিন্দি, তামিল সহ নানা ভারতীয় ভাষায় তিনি প্রায় সাত হাজারের উপর গান গেয়েছেন।
মোহাম্মদ রফি সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য:
⏰ জন্ম: ২৪ ডিসেম্বর ১৯২৪, কোটলা সুলতান সিং, পাঞ্জাব, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান পাঞ্জাব, ভারত)।⏰ মৃত্যু: ৩১ জুলাই ১৯৮০ (৫৫ বছর বয়সে), বোম্বে, মহারাষ্ট্র, ভারত।
🎹 পেশা: নেপথ্য গায়ক। সক্রিয়ভাবে সঙ্গীত চর্চা করেছেন ১৯৪৪-১৯৮০ পর্যন্ত।
পরিবার ও বাল্যকাল:
জন্ম ও জন্মস্থান :
১৯২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর মোহাম্মদ রফি পাঞ্জাবি (ব্রিটিশ ভারত, বর্তমান পাঞ্জাব, কোটলা) জাট মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হাজী আলী মোহাম্মদ একজন কাপড় ব্যবসায়ী। তাঁর ৬ সন্তানের মধ্যে মহম্মদ রফি ছিলেন দ্বিতীয়। ছোটবেলায় তাঁকে আদর করে ‘ফিকো’ ডাকা হত। গ্রামের এক ফকিরের ভজন গান অনুকরণ করে তিনি গান গাওয়া শুরু করেন।
১৯৩৫ সালে তাঁর বাবা জীবিকার সন্ধানে পরিবার নিয়ে লাহোরে চলে যান। লাহোরে তাঁর বড় ভাই মোহাম্মদ দ্বীনের বন্ধু আবদুল হামিদ রফির সঙ্গীত প্রতিভা দেখে তাঁকে গান গাওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। হামিদের অনুপ্রেরণায় রফি সঙ্গীত শিক্ষা শুরু করেন।
‘গাঁও কি গৌরী’ (১৯৪৫) চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বলিউডে নিজের স্থান করে নেন। এরপর তিনি তাঁর কর্মজীবনে প্রায় চার দশক ধরে গান গেয়েছেন। ধারণা করা হয়, তিনি ২৬,০০০ এরও বেশি গান গেয়েছেন। তাঁর গানগুলি বিভিন্ন ঘরানার ছিল, যেমন- ধ্রুপদী, দেশাত্মবোধক, বিরহের গান, রোমান্টিক গান, কাওয়ালি, গজল এবং ভজন।
🏅২০০১ সালে ‘হিরো হোন্ডা’ এবং 'স্টারডাস্ট' ম্যাগাজিন তাঁকে ‘শতাব্দীর সেরা গায়ক’ উপাধি প্রদান করে।
🏅ফিল্মফেয়ার পুরস্কার সেরা পুরুষ নেপথ্য গায়কের পুরস্কার ৬ বার (একটি রেকর্ড)।
🏅বিশ্ব রেকর্ড: গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস (১৯৭৭) অনুসারে তিনি সর্বকালের সবচেয়ে বেশি (প্রায় ২৮,০০০) গান রেকর্ড করেছেন এমন গায়ক হিসেবে স্বীকৃত (যদিও এই সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে, তবুও এটা তাঁর অপরিসীম অবদানের প্রমাণ)।
মোহাম্মদ রফি একটি বিশাল সঙ্গীত ভাণ্ডার রেখে গেছেন যা আজও শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। তাই আজ শুধু একজন মহান শিল্পীকে হারানোর শোকের দিন নয়, তাঁর অতুলনীয় সঙ্গীতভাণ্ডার ও অবদানকে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করার দিন।
সঙ্গীত জীবন:
ছোটবেলা থেকেই ফকির ও সূফী সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ ছিল। মাত্র ১৩ বছর বয়সে লাহোরে প্রখ্যাত শিল্পী কে. এল. সাইগলের সঙ্গে কনসার্টে গান গেয়ে তিনি প্রথম দর্শক-শ্রোতার সামনে আসেন।১) নেপথ্য গায়ক হিসেবে অভিষেক :
১৯৪১ সালে শ্যাম সুন্দরের নির্দেশনায় লাহোরে পাঞ্জাবি চলচ্চিত্র ‘গুল বালুচ’ (১৯৪৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত) চলচ্চিত্রে জিনাত বেগমের সঙ্গে দ্বৈত সঙ্গীত ‘সোনিয়ে নি, হেরিয়ে নি’ গানের মাধ্যমে তাঁর নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে অভিষেক হয়। একই বছর তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওর লাহোর সম্প্রচার কেন্দ্রে গান গাওয়ার জন্য আমন্ত্রিত হন। ১৯৪৪ সালে তিনি মুম্বাইতে (বর্তমান মুম্বাই) চলে আসেন।২) শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম :
সেখানে তিনি ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান, ওস্তাদ আব্দুল ওয়াহিদ খান, পণ্ডিত জীবনলাল মত্তো এবং ফিরোজ নিজামীর মতো প্রথিতযশা গুরুদের কাছে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেন।৩) বহু ধরার গান :
১৯৪৪ সালে মুম্বাই (তৎকালীন বোম্বে) আসেন। সঙ্গীত পরিচালক নওশাদ আলী তাঁকে প্রথম সুযোগ দেন চলচ্চিত্র ‘পেহলে আপ’ (১৯৪৪) -এ গান ‘হিন্দুস্তান কে হাম হ্যায়’ গাওয়ার মাধ্যমে।
নওশাদের সহযোগী: নওশাদ রফির ক্যারিয়ারের অন্যতম প্রধান স্থপতি। ‘বাবুল’ (১৯৫০), ‘দিওয়ানা’ (১৯৫২), ‘মাদার ইন্ডিয়া’ (১৯৫৭), ‘মুঘল-ই-আজম’ (১৯৬০) সহ অসংখ্য কালজয়ী গান রেকর্ড করেন নওশাদের সুরে।
বহুমুখী প্রতিভা: রফি কেবল রোমান্টিক বা মেলোডিয়াস গানেই নয়, ধ্রুপদী, দেশাত্মবোধক, বিরহের গান, কাওয়ালি, গজল এবং ভজন। – প্রতিটি ঘরানায় সমান দক্ষতা ও আবেগ নিয়ে গাইতে পারতেন।
৪) বিভিন্ন ভাষায় গান
তিনি হিন্দি এবং উর্দুতে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। এছাড়াও তিনি কঙ্কণী, ভোজপুরী, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, বাংলা, মারাঠি, সিন্ধি, কন্নড়, গুজরাটি, তেলেগু, মাঘী, মৈথিলী এবং অসমিয়া সহ বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় গান গেয়েছেন। কিছু ইংরেজি, ফারসি, স্প্যানিশ এবং ডাচ গানও রেকর্ড করেছেন।৫) অভিনেতাদের কণ্ঠ:
দিলীপ কুমার, রাজ কাপুর, দেব আনন্দ, শাম্মী কাপুর, রাজেন্দ্র কুমার, জীতেন্দ্র, ধর্মেন্দ্র, অমিতাভ বচ্চনসহ প্রায় *সকল* নায়কের জন্য তাঁর কণ্ঠ ব্যবহৃত হয়েছে।
৬) কিছু কালজয়ী গান:
* ‘চৌদ্দবীন কা চাঁদ হো’ (চৌদ্দবীন কা চাঁদ, ১৯৬০)
* ‘ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে’ (শোলে, ১৯৭৫)
* ‘বাহারো ফুল বারসাও’ (সুরজ, ১৯৬৬)
* ‘খেয়াল কীয়া দিনো কা’ (শগুন, ১৯৬৪)
* ‘দিল কে ঝারোখে মে’ (ব্রহ্মচারী, ১৯৬৮)
* ‘ম্যাঁ গ্যায়া জাহাঁ সে’ (আঁখে, ১৯৬৮)
* ‘সুরাত ন বনাইয়ে’ (সুরাজ, ১৯৬৬)
* ‘ম্যাঁ জিন্দা কা পায়া হুঁ’ (হকীকত, ১৯৬৪)
* ‘তেরি প্যায়ারী প্যারী আখোঁকে’ (সসুরাল, ১৯৬১)
* ‘ম্যাঁ জাতু কা ধনী’ (কারওয়াঁ, ১৯৬৫)
* ‘ও দুনিয়া কে রাখওয়ালে’ (বাইজু বাওরা, ১৯৫২) - ভজন
৭) মোহাম্মদ রফির বিশেষত্ব :
তিনি নওশাদ, ও. পি. নাইয়ার, শঙ্কর-জয়কিষণ, এস. ডি. বর্মন, মদন মোহন, রবি এবং লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলালের মতো অনেক বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। রফির একটি বিশেষত্ব ছিল যে তিনি অভিনেতাদের কণ্ঠস্বর এবং onscreen ব্যক্তিত্বের সাথে তাঁর কণ্ঠকে পুরোপুরি মানিয়ে নিতে পারতেন।৮) মোহাম্মদ রফির বাংলা গান :
তোমার নীল দোপাটি চোখ, পাখিটার বুকে যেন, এখনই বিদায় বল না, কথা ছিল দেখা হলে, ওই দূর দিগন্ত পারে, গুলমোহরের ফুল ঝরে যায়, নাই বা পরিলে আজ মালা চন্দন, এ জীবনে যদি আর কোনো দিন, নওল কিশোর, কালো কলেবর কানহাই, ওরে মনকে এমন দাগা দিয়ে, নজরুল সংগীত ‘আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন’।পুরস্কার ও সম্মাননা:
🏅ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার - ১ বার।🏅২০০১ সালে ‘হিরো হোন্ডা’ এবং 'স্টারডাস্ট' ম্যাগাজিন তাঁকে ‘শতাব্দীর সেরা গায়ক’ উপাধি প্রদান করে।
🏅ফিল্মফেয়ার পুরস্কার সেরা পুরুষ নেপথ্য গায়কের পুরস্কার ৬ বার (একটি রেকর্ড)।
- ১৯৬১: ‘চৌদ্দবীন কা চাঁদ হো’ (চৌদ্দবীন কা চাঁদ)
- ১৯৬৪: ‘চাহুংগা ম্যাঁ তুঝে’ (দোস্তি)
- ১৯৬৬: ‘বাহারো ফুল বারসাও’ (সুরজ)
- ১৯৬৮: ‘দিল কে ঝারোখে মে’ (ব্রহ্মচারী)
- ১৯৭৭: ‘ক্যা হুয়া তেরা ওয়াদা’ (হাম কিসি সে কাম নেহি)
- ১৯৭৯: ‘আপকে আনসুওঁ মে’ (সরগম)
🏅বিশ্ব রেকর্ড: গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস (১৯৭৭) অনুসারে তিনি সর্বকালের সবচেয়ে বেশি (প্রায় ২৮,০০০) গান রেকর্ড করেছেন এমন গায়ক হিসেবে স্বীকৃত (যদিও এই সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে, তবুও এটা তাঁর অপরিসীম অবদানের প্রমাণ)।
প্রয়াণ দিবস :
মৃত্যু: ৩১ জুলাই, ১৯৮০। হৃদরোগে আচমকা আক্রান্ত হয়ে মুম্বাইয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে সমগ্র ভারতবর্ষ শোকাহত হয়।
অমর উত্তরাধিকার:
মোহাম্মদ রফি কেবল একজন গায়কই ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক আবেগের প্রতিমূর্তি। তাঁর কণ্ঠের বিশুদ্ধতা, সুরের নিখুঁত অনুভূতি, গায়কীর গভীরতা এবং অসাধারণ শ্রমনিষ্ঠা তাঁকে হিন্দি চলচ্চিত্র সঙ্গীতের ইতিহাসে এক অনন্য উচ্চতায় স্থান দিয়েছে। আজও তাঁর গান কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে স্পন্দিত হয়। তিনি ‘রফি সাবা’ নামে স্নেহ ও শ্রদ্ধায় স্মরণিত হন।
মোহাম্মদ রফি একটি বিশাল সঙ্গীত ভাণ্ডার রেখে গেছেন যা আজও শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। তাই আজ শুধু একজন মহান শিল্পীকে হারানোর শোকের দিন নয়, তাঁর অতুলনীয় সঙ্গীতভাণ্ডার ও অবদানকে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করার দিন।
------------xx-----------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন