এসআইআর (SIR) কী?
এসআইআর (SIR) কী?
What is SIR?
ভারতীয় নির্বাচন কমিশন ২০২৫ সালের জুন মাসে বিহারে ভোটার তালিকার ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধন’ (SIR) করার ঘোষণা দিয়েছে। এসআইআর (SIR) মানে হল ‘Special Intensive Revision of Electoral Rolls’, অর্থাৎ ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় পর্যালোচনা বা সমীক্ষা। এটি একটি ব্যাপক প্রক্রিয়া, যা নিয়মিত ভোটার তালিকা হালনাগাদের চেয়ে আরও বিশদ এবং গভীর যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।এসআইআর-এর মূল উদ্দেশ্য:
১. ত্রুটিমুক্ত ও নির্ভুল ভোটার তালিকা তৈরি:
- ভোটার তালিকায় কোনো রকম ভুল তথ্য, যেমন - নামের ভুল, ঠিকানার ভুল, জন্মতারিখের ভুল, ইত্যাদি থাকলে তা সংশোধন করা।
- একই ব্যক্তির নাম একাধিকবার থাকলে বা ভুয়া ভোটারের নাম থাকলে তা বাদ দেওয়া।
- মৃত ব্যক্তিদের নাম তালিকা থেকে মুছে ফেলা।
- স্থানান্তরিত (shifted) ভোটারদের নাম সঠিক স্থানে অন্তর্ভুক্ত করা।
২. সকল যোগ্য নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত করা:
- যারা ১৮ বছর পূর্ণ করেছেন এবং ভোটার হওয়ার যোগ্য, কিন্তু এখনো ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি, তাদের নাম যোগ করা।
- যারা অন্য কোনো কারণে বাদ পড়েছেন, তাদের নাম যাচাই করে অন্তর্ভুক্ত করা।
৩. ভোটার তালিকার অখণ্ডতা বজায় রাখা:
- একটি স্বচ্ছ এবং নির্ভরযোগ্য ভোটার তালিকা নির্বাচন প্রক্রিয়ার মূল ভিত্তি। এসআইআর এই অখণ্ডতা বজায় রাখতে সাহায্য করে, যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা যায়।
- এটি ‘এক ব্যক্তি, এক ভোট’ নীতিকে সুনিশ্চিত করে।
৪. জনগণনা এবং সীমানা পুনর্নির্ধারণের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করা:
প্রতি দশ বছর অন্তর জনগণনা (Census) হয় এবং এর ভিত্তিতে নির্বাচন কেন্দ্রগুলির সীমানা পুনর্নির্ধারণ (delimitation) করা হয়। এসআইআর ভোটার তালিকাগুলিকে এই নতুন সীমানা এবং জনসংখ্যার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করতে সাহায্য করে।৫. রাজনৈতিক দলগুলির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা:
এই প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলিকে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে উৎসাহিত করা হয়, যাতে তাদের প্রতিনিধিরা ভোটার তালিকা যাচাইয়ে সহায়তা করতে পারে এবং এর স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায়।৬. নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন:
ভোটার তালিকা তৈরি ও হালনাগাদ করা ভারতের নির্বাচন কমিশনের একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব। এসআইআর এই দায়িত্ব পালনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।বর্তমান প্রেক্ষাপট:
বিরোধী দল গুলির বিরোধিতা :
সম্প্রতি বিহারে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই এসআইআর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং এটি জাতীয় পর্যায়েও সম্প্রসারিত করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে কিছু বিতর্কও সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে বিরোধীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে, এর মাধ্যমে কিছু বৈধ ভোটারকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হতে পারে।বিরোধীদের বিরোধিতার কারণ :
✅ ১) ভোটার তালিকা সংশোধনের জন্য আপাত দৃষ্টিতে গৃহীত এসআইআর প্রক্রিয়াটি বিজেপি পরিচালিত সরকারের নির্দেশে চলা নির্বাচন কমিশনের আমলা তান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতা, আইনগতভাবে অসংগতিপূর্ণ এবং নাগরিকত্বের বিষয়ে স্বৈরাচারী বোঝাপড়ার ইচ্ছাকৃত প্রক্রিয়া।
✅ ২) নির্বাচন কমিশনের যুক্তি হল, তারা ভোটার তালিকা বিদেশী মুক্ত করে ‘শুদ্ধ’ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। তাহলে প্রশ্ন হল —
👉 ক) বিহারে সাধারণ নির্বাচন মাত্র এক বছর আগে (২০২৫) অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং তখন ভোটার তালিকাকে সময়োপযোগী করা হয়েছিল। সুতরাং বিধানসভা নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে (২০২৫) আবার এই সংশোধনের যুক্তি কী? বিরোধীরা বলছেন এই কাজ অত্যন্ত সন্দেহজনক এবং রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
👉 খ) নির্বাচন কমিশন ২১ জুলাই সুপ্রিম কোর্টে হলফনামার সাথে যে অভিযোগগুলির একটি প্রাথমিক পর্যালোচনা পেশ করেছে সেগুলির বেশিরভাগই সাধারণ ত্রুটি। যেমন, ১) ভোটার তালিকায় ভুও নাম, ২) স্থানান্তরিত ও মৃত ভোটারদের নাম বাদ না পড়া, ৩) যোগ্য ভোটারদের বাদ দেওয়া, ৪) দুবার একই ভোটারের নাম থাকা ইত্যাদি। এই তথ্যগুলি নির্বাচিত কমিশনের হলফনামার প্রায় ৮০ শতাংশ জুড়ে রয়েছে। এই হলফনামার কোথাও বাংলাদেশ, মায়ানমার ইত্যাদি বিদেশি দেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীদের রাজ্যে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়নি।
এখানেই প্রশ্ন উঠছে, যদি তা না হয়, তাহলে এসআইআর এর মাধ্যমে ভোটারদের নাগরিকত্ব পরীক্ষার যৌক্তিকতা কী?
✅ ৩) হঠাৎ ২২ বছর আগের ভোটার তালিকাকে কেন মানদন্ড হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে? সর্বশেষ ভোটার তালিকার ভিত্তিতেই তো বারবার এটা করা হয়ে থাকে।
✅ ৪) ২০০৩ সালের পর জন্মগ্রহণকারী ভোটারদের কীভাবে সেই তালিকাভুক্ত করা যাবে?
✅ ৫) ভোটার তালিকায় নাম তোলার সময় যথাযথ প্রমাণ দেওয়ার পরেও কেন ভোটারদের প্রমাণ করতে হবে যে তাদের বাবা-মা সেই তালিকায় ছিলেন?
✅ ৬) ২০০৩ সাল থেকে পরপর লোকসভা বিধানসভার নির্বাচনে যারা ভোট দিলেন, তাদেরও কেন কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে?
✅ ৭) নিয়মিত বন্যা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দরিদ্র, নিরক্ষর ও প্রান্তিক মানুষের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নষ্ট হয়ে যায় অথবা হারিয়ে যায়। এইসব নথি তারা নতুন করে কীভাবে জোগাড় করবে?
✅ ৮) নাগরিকত্বের প্রমাণ দাখিল করার জন্য যে সময়-সীমা দেওয়া হয়েছে তা অত্যন্ত অপ্রতুল। ফলে বহু যোগ্য ভোটার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাগজপত্র জমা দিতে পারবেন না।
✅ ৯) অধিকাংশ রাজ্যে বিপুল পরিমাণ সরকারি পদ শূন্য পড়ে রয়েছে। নাগরিকত্বের প্রমাণ যাচাইয়ের এই প্রক্রিয়াটি পরিচালনার জন্য যে বিপুল সংখ্যক কর্মীর প্রয়োজন তা কীভাবে মেটানো হবে। কর্মীর অভাবে প্রশাসনের উপর অত্যধিক চাপ তৈরি হবে এবং এর ফলে প্রশাসনিক ভুল ও অসঙ্গতি থেকে যাবার প্রবল সম্ভাবনা থাকছে।
✅ ১০) ১৯৫০ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইন (৩২৬ অনুচ্ছেদ) অনুযায়ী ১৮ বছরের বেশি বয়সী প্রতিটি নাগরিকের ভোট দেওয়ার অধিকার রয়েছে। আইনে বলে দেওয়া আছে এমন (যেমন মানসিক অক্ষমতা, ফৌজদারী মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া ইত্যাদি) ব্যক্তিরাই কেবল এই অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে। এসআইআর জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের এই ধারা লঙ্ঘন করছে। কারণ, কাগজ না দেখাতে পারলে তাদের ভোটাধিকার চলে যাবে অথবা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি আটকে যাবে।
তবে নির্বাচন কমিশন জোর দিয়ে বলেছে যে, এর উদ্দেশ্য হল ভোটার তালিকা পরিষ্কার করা এবং যোগ্য কোনো ভোটার যাতে বাদ না পড়েন তা নিশ্চিত করা। এই প্রক্রিয়ায় ভোটারদেরকে নির্দিষ্ট কিছু নথি (যেমন - জন্মস্থান বা বসবাসের প্রমাণপত্র) জমা দিতে বলা হচ্ছে, যা নিয়েও আলোচনা চলছে।
সংক্ষেপে, এসআইআর একটি নিবিড় এবং সময়বদ্ধ প্রক্রিয়া যা ভোটার তালিকা নির্ভুল, সম্পূর্ণ এবং বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার মাধ্যমে ভারতের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মূল ভিত্তি মজবুত করে।
--------xx-------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন