মেরিলিন মনরোর আত্মহত্যা
মেরিলিন মনরোর আত্মহত্যা :
Marilyn Monroe's suicide
১৯৬২ সালের ৫ আগস্ট। আমেরিকার ৩৬ বছর বয়সি অভিনেত্রী মেরিলিন মনরো আত্মহত্যা (?) করেন। এই দিন ভোররাতে তাঁকে তাঁর বাড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তদন্তে জানা যায়, ৪০টি বারবিচুরেট পিল সেবন করে, তাঁর আগের সন্ধেয় তাঁর মৃত্যু ঘটে। মেরিলিন মনরো ছিলেন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে আইকনিক ও প্রভাবশালী মার্কিন অভিনেত্রী, যার জীবন ও মৃত্যু আজও বিশ্বজুড়ে আলোচিত।
প্রারম্ভিক জীবন ও শৈশব :
মেরিলিন মনরো ১৯২৬ সালের ১ জুন ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা, গ্ল্যাডিস পার্ল বেকার, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতেন। মনরোর শৈশব ছিল কঠিন। তিনি তাঁর শৈশবের বেশিরভাগ সময় অনাথ আশ্রম এবং বিভিন্ন পালক পরিবারের কাছে কাটিয়েছেন। তাঁর মায়ের মানসিক অসুস্থতার কারণে তিনি মেয়েকে সঠিকভাবে লালন-পালন করতে পারেননি। ফলে ১১টি ফস্টার হোম ও অনাথাশ্রমে থেকে তিনি বড় হন। মনরোর বাবার পরিচয় অজ্ঞাত ছিল, এবং তিনি কখনো তাঁর বাবাকে চিনতে পারেননি।কর্মজীবনের সূচনা :
বিবাহবিচ্ছেদের পর একজন ফটোগ্রাফারের চোখে পড়েন। ১৯৪৪ সালে একটি বিমান কারখানায় কাজ করার সময় ওই ফটোগ্রাফার ডেভিড কনোভার তাঁর ছবি তোলেন, যা ‘ইয়াঙ্ক ম্যাগাজিনে’ প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি মডেলিং-এ ডাক পান এবং মডেলিং শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্সের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন এবং তাঁর নাম পরিবর্তন করে মেরিলিন মনরো রাখেন।প্রথম দিকে তিনি ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করলেও, ১৯৫০ সালে ‘দ্য অ্যাসফল্ট জাঙ্গল’ এবং ‘অল অ্যাবাউট ইভ’ চলচ্চিত্রে তার অভিনয় সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
২) জো ডিমাগিও (১৯৫৪): বিখ্যাত বেসবল খেলোয়াড়। তাদের বিবাহ মাত্র ৯ মাস টিকেছিল।
৩) আর্থার মিলার (১৯৫৬-১৯৬১): বিখ্যাত নাট্যকার। মিলার তার জন্য ‘দ্য মিসফিটস’ (১৯৬১) চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন, যা মনরোর শেষ চলচ্চিত্র ছিল।
মেরিলিন মনরো তাঁর সৌন্দর্য, অভিনয় প্রতিভা, এবং ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখজনক ঘটনার জন্য আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি এখনও পপ সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হন।
খ্যাতি এবং চলচ্চিত্র :
১৯৫৩ সালে তিনি ‘জেন্টলমেন প্রেফার ব্লন্ডস’(আইকনিক ‘ডায়মন্ডস আর আ গার্লস বেস্ট ফ্রেন্ড’ গানসহ), ‘হাউ টু ম্যারি আ মিলিয়নিয়ার’, এবং ‘নায়াগ্রা’ (এই ছবিতেই প্রথম প্রধান ভূমিকায় সেক্স সিম্বল ইমেজ প্রতিষ্ঠা পায়) চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করে তারকাখ্যাতি পান। ‘হাউ টু ম্যারি আ মিলিয়নিয়ার’ তাঁকে সুপারস্টারে পরিণত করে।দ্য সেভেন ইয়ার ইচ (১৯৫৫) সাদা পোশাকে ভেন্টিলেটরে দাঁড়ানো দৃশ্য তাঁকে কালচারাল আইকনে পরিণত হয়। তাঁর ‘ডাম্ব ব্লন্ড’ (dumb blonde) চরিত্রটি তাঁকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দেয়।
তবে, তিনি এই টাইপকাস্টিং থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন এবং অভিনয়ের দক্ষতা বাড়াতে অ্যাক্টরস স্টুডিওতে পড়াশোনা করেন। এর ফলস্বরূপ, ‘বাস স্টপ’ (১৯৫৬) এবং ‘সাম লাইক ইট হট’ (১৯৫৯)-এর মতো চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয়। ‘সাম লাইক ইট হট’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য তিনি গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ডও লাভ করেন। এই ছবিটি সর্বকালের সেরা কৌতুকনাট্যগুলোর মধ্যে গণ্য। ‘ওয়েল, নোবডি পারফেক্ট!’ সংলাপ বিখ্যাত।
‘দ্য মিসফিটস’ (১৯৬১) হল তাঁর শেষ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, লেখক আর্থার মিলারের জন্য লেখা।
ব্যক্তিগত জীবন :
মনরোর ব্যক্তিগত জীবন ছিল অত্যন্ত আলোচিত। তিনি মোট তিনটি বিয়ে করেছিলেন:👫 বৈবাহিক সম্পর্ক :
১) জেমস ডগার্টি (১৯৪২-১৯৪৬): শৈশবের প্রতিবেশী। ১৬ বছর বয়সে তিনি জেমস ডগার্টি নামে একজন প্রতিবেশীকে বিয়ে করেন, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়।২) জো ডিমাগিও (১৯৫৪): বিখ্যাত বেসবল খেলোয়াড়। তাদের বিবাহ মাত্র ৯ মাস টিকেছিল।
৩) আর্থার মিলার (১৯৫৬-১৯৬১): বিখ্যাত নাট্যকার। মিলার তার জন্য ‘দ্য মিসফিটস’ (১৯৬১) চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন, যা মনরোর শেষ চলচ্চিত্র ছিল।
😱 মনস্তাত্ত্বিক সংগ্রাম :
দীর্ঘদিন বিষণ্নতা, উদ্বেগ ও নিদ্রাহীনতায় ভুগেছেন। মাদক ও অ্যালকোহলে আসক্তি ছিল। একাধিকবার গর্ভধারণ এবং শেষ পর্যন্ত গর্ভপাত করাতে বাধ্য হন, যা তাঁর মানসিক যন্ত্রণা বাড়ায়।
মৃত্যু না আত্মহত্যা :
১) আত্মহত্যা :
মেরিলিন মনরো ১৯৬২ সালের ৫ আগস্ট মাত্র ৩৬ বছর বয়সে লস অ্যাঞ্জেলেসে নিজ বাড়িতে মারা যান। তার মৃত্যুর কারণ ছিল ঘুমের ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত সেবন। তার মৃত্যুর পরিস্থিতি নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা রয়েছে।২) কনস্পিরেসি থিওরি :
জন এফ. কেনেডি ও তার ভাই রবার্ট কেনেডির সাথে প্রেমের সম্পর্ক এবং মাফিয়া সংযোগ নিয়ে অসংখ্য তত্ত্ব প্রচলিত। মৃত্যু তদন্তে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
সাংস্কৃতিক প্রভাব:
আইকনিক ইমেজ :
প্ল্যাটিনাম ব্লন্ড চুল, রেড লিপস্টিক, মোলায়েম কণ্ঠ ও "সেক্স সিম্বল" ইমেজ পপ কালচারে অমর।
নারীবাদী পুনর্মূল্যায়ন :
জীবনের দ্বন্দ্ব (বুদ্ধিমত্তা vs. স্টেরিওটাইপ) আধুনিক নারীবাদের আলোচ্য বিষয়।
শিল্প ও ফ্যাশনে প্রভাব :
অ্যান্ডি ওয়ারহোলের সিল্কস্ক্রিন, মডার্ন ফটোগ্রাফি ও ফ্যাশনে অনুপ্রেরণা।
পুরস্কার ও সম্মাননা :
মেরিলিন মনরো তার স্বল্পকালীন ক্যারিয়ারে বাণিজ্যিক সাফল্য ও সাংস্কৃতিক আইকনিক মর্যাদা পেলেও প্রধান চলচ্চিত্র পুরস্কারে তুলনামূলকভাবে কম স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। তাঁর প্রাপ্ত সম্মাননা ও মনোনয়নগুলোর বিস্তারিত তালিকা নিচে দেওয়া হলো:
ক) প্রধান পুরস্কার প্রাপ্তি:
1. গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড (জিতেছেন):
- ১৯৬০ সালের সেরা অভিনেত্রী (মিউজিক্যাল বা কমেডি)
চলচ্চিত্র: Some Like It Hot (সাম লাইক ইট হট)
(এই পুরস্কারটিই তাঁর অভিনয় জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জয়)
2. ‘ডেভিড ডি ডোনাটেলো অ্যাওয়ার্ড’ (যাকে ইতালিয়ান ‘অস্কার’ বলে অভিহিত করা হয়):
- ১৯৫৮ : সেরা বিদেশি অভিনেত্রী হিসাবে তিনি এই পুরস্কার পান ‘The Prince and the Showgirl’ (প্রিন্স অ্যান্ড দ্য শোগার্ল) চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য।
খ) গুরুত্বপূর্ণ মনোনয়ন:
এ ছাড়া কিছু বিদেশি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি এই পুরস্কার লাভে সক্ষম হননি।
1. ‘বাফটা অ্যাওয়ার্ড’ (এটা ব্রিটিশ একাডেমি ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড):
- ১৯৫৭ : সেরা বিদেশি অভিনেত্রী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন Bus Stop (বাস স্টপ) চলচ্চিত্রের জন্য।
- ১৯৬০ সালে ‘Some Like It Hot’ চলচ্চিত্রের জন্য সেরা বিদেশি অভিনেত্রী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন।
2. গোল্ডেন গ্লোব :
- ১৯৫৭ সালের সেরা অভিনেত্রী (ড্রামা) বিভাগে ‘গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড’ এর জন্য মনোনীত হয়েছিল তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্র ‘Bus Stop’.
গ) মরণোত্তর সম্মাননা:
1. ‘হলিউড ওয়াক অব ফেম’ (১৯৬০): তারকা নং 6774 (ভাইন স্ট্রিটে অবস্থিত)।
2. ‘গ্র্যামি হল অব ফেম’ (১৯৯৯): আইকনিক গান ‘I Wanna Be Loved By You’ অন্তর্ভুক্তি।
3. মার্কিন ডাক বিভাগের স্মরণীয় ডাকটিকিট (১৯৯৫) : তাঁর প্রতিকৃতি সম্বলিত ‘লেজেন্ডস অব হলিউড’ সিরিজের ডাকটিকিট প্রকাশ।
ঘ) অন্যান্য স্বীকৃতি :
১) আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট (AFI) :
‘Some Like It Hot’ সর্বকালের সেরা আমেরিকান কমেডি (২০০০) হিসেবে নির্বাচিত হয়। মনরোকে ‘সর্বকালের সেরা নারী তারকা’ হিসাবে তালিকাভুক্ত (১৯৯৯)।
২) লাইব্রেরি অব কংগ্রেস :
Gentlemen Prefer Blondes (১৯৫৩) ও Some Like It Hot (১৯৫৯) চলচ্চিত্র দুটি ‘জাতীয় চলচ্চিত্র রেজিস্ট্রি’তে সংরক্ষণ হওবার যোগ্যতা অর্জন করেছে।
বিতর্ক ও উপেক্ষা:
১) অস্কার (Academy Awards) :
মনরো কখনও অস্কারের জন্য মনোনীত হননি, যা তাঁর অনস্বীকার্য জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও সমালোচকদের দ্বারা ‘হালকা’ ভূমিকা হিসেবে বিবেচিত হওয়াকে নির্দেশ করে।
- ১৯৫১ সালে All About Eve চলচ্চিত্রে তাঁর ছোট ভূমিকা (মিস ক্যাসওয়েল) সত্ত্বেও সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী বিভাগে মনোনয়ন পায়নি।
২) ক্যারিয়ার সীমাবদ্ধতা :
স্টুডিও ব্যবস্থা তাঁকে প্রায়শই ‘স্টেরিওটাইপিক ব্লন্ড’ ভূমিকায় সীমাবদ্ধ রেখেছিল, যা তার অভিনয়ের পরিসরকে প্রভাবিত করেছিল।
৩) সাংস্কৃতিক প্রভাবের স্বীকৃতি:
I) ফরবস ম্যাগাজিন : মৃত্যুর পরেও সর্বোচ্চ আয়কারী মৃত সেলিব্রিটিদের তালিকায় নিয়মিত অবস্থান (২০২৩-এ $১৭ মিলিয়ন আয়) তাঁর।
II) টাইম ম্যাগাজিন : ‘২০শ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তি’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে (১৯৯৯)।
বিশ্লেষণ:
মনরোর পুরস্কার প্রাপ্তি তাঁর বৈশ্বিক খ্যাতির সাথে বেমানান মনে হলেও এটি তাঁর সময়ের চলচ্চিত্র শিল্পের রক্ষণশীলতা ও ‘সেক্স সিম্বল ইমেজের কারণে সমালোচকদের অবমূল্যায়নের’ প্রতিফলন। তবুও Some Like It Hot-এ তাঁর অভিনয়কে আজও কমেডির মাস্টারক্লাস হিসেবে স্বীকৃত দেওয়া হয়। তাঁর ‘স্থায়ী প্রভাব’ পুরস্কারের তালিকার চেয়ে অনেক গভীর—তিনি পপ আর্ট, ফ্যাশন ও নারীর আত্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ক আলোচনায় অনুপ্রেরণা হয়ে আছেন।
আসলে মনরোর জীবন ট্র্যাজেডি ও উজ্জ্বলতার এক অসাধারণ মিশ্রণ। মাত্র ৩০টি চলচ্চিত্রে কাজ করেও তিনি বিশ্বব্যাপী অমরতার মর্যাদা পেয়েছেন, যা তাঁর অনন্য ক্যারিশমা ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের প্রমাণ। তাঁর জীবনী নিয়ে অসংখ্য বই, চলচ্চিত্র (যেমন: ‘ব্লন্ড’, ২০২২) ও ডকুমেন্টারি তৈরি হয়েছে।
অপ্রকাশিত দিক:
পড়াশোনার নেশা : ৪০০+ বইয়ের ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ছিল; কবিতা লিখতেন।
অভিনয় কোচ : লি স্ট্রাসবার্গের অ্যাক্টর্স স্টুডিওতে মেথড অ্যাক্টিং শিখতেন।
মেরিলিন মনরো তাঁর সৌন্দর্য, অভিনয় প্রতিভা, এবং ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখজনক ঘটনার জন্য আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি এখনও পপ সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হন।
------------xx-----------
আরও নির্দিষ্ট কোন দিক (যেমন: তার চলচ্চিত্রের তালিকা, কেনেডি পরিবারের সাথে সম্পর্ক, বা স্টাইল) জানতে চাইলে জানাবেন!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন