পি ভি নরসিমহা রাও-এর জন্মদিন

পি ভি নরসিমহা রাও এর জন্মদিন

P. V. Narasimha Rao’s Birthday

১৯২১ সালের ২৮ জুন। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমহা রাও জন্মগ্রহণ করেন; হায়দ্রাবাদ রাজ্যের (বর্তমানে তেলেঙ্গানা) করিমনগর শহরে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন। তিনি ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর শাসন আমলে (১৯৯২) অযোধ্যার ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছিল।

পি. ভি. নরসিমহা রাও (P. V. Narasimha Rao) ছিলেন ভারতের নবম প্রধানমন্ত্রী (১৯৯১–১৯৯৬)।

প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা:

পি. ভি. নরসিমহা রাও এর পুরো নাম পামুলাপর্তি ভেঙ্কট নরসিমহা রাও। ১৯২১ সালে একটি তেলেগু ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর জন্ম। তিনি একজন অসাধারণ মেধাবী ছাত্র ছিলেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান ও আইনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

তিনি ৮টি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। এগুলো হল তেলেগু, হিন্দি, ইংরেজি, সংস্কৃত, মারাঠি, উর্দু, ফরাসি এবং স্প্যানিশ

রাজনৈতিক ক্যারিয়ার:

১) প্রারম্ভিক পর্যায় (১৯৫০–১৯৭০):

১৯৫০-এর দশকে ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পার্টি’-তে যোগদান করেন এবং অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য রাজনীতিতে সক্রিয় হন।
১৯৬২ সালে ‘অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভা’-র সদস্য নির্বাচিত হন।  
১৯৭১ সালে ‘ইন্দিরা গান্ধী’-র সরকারে মন্ত্রী হন (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্যসম্প্রচার মন্ত্রণালয়)।

২) কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে উত্থান (১৯৮০–১৯৯১):

▪️ ১৯৮০-র দশকে রাজীব গান্ধী-র সরকারে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দায়িত্ব পান (গৃহমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী)।  
▪️ ১৯৯১ সালে কংগ্রেসের নেতৃত্ব: রাজীব গান্ধী হত্যার পর কংগ্রেস দলীয় নেতা হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ২১ জুন ১৯৯১-এ প্রধানমন্ত্রী হন।  

৩) প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অবদান (১৯৯১–১৯৯৬):

নরসিমহা রাও ভারতের আধুনিক অর্থনৈতিক সংস্কারের স্থপতি হিসেবে পরিচিত। তাঁর সরকারের সময়ে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে:  

I. অর্থনৈতিক সংস্কার (১৯৯১-এর লিবারালাইজেশন):  

✅ ড. মনমোহন সিং-কে অর্থমন্ত্রী করে বাজেট ঘোষণা (১৯৯১)-এ ঐতিহাসিক সংস্কার শুরু করেন।  
LIC, RBI, IMF-এর সহায়তায় ভারতের অর্থনীতিকে উদারীকরণ করা হয়।  
✅ লাইসেন্স রাজ বিলোপ, বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণ, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবিলা।  
SEBI গঠন (১৯৯২) এবং শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রণ।  

II. বৈদেশিক নীতি:

- লুক ইস্ট পলিসি (Look East Policy) চালু করে ASEAN ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে সম্পর্ক জোরদার করেন।  
- ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন (১৯৯২)।  
- পোখরান-২ পরমাণু পরীক্ষা-র প্রস্তুতি শুরু (যদিও এটি ১৯৯৮-এ বাজপেয়ী সরকার করে)।  

III. সামাজিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন:

✅ পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থা (৭৩তম সংবিধান সংশোধন, ১৯৯২) বাস্তবায়ন, যা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন শক্তিশালী করে।  
✅ টেলিকম ও IT সেক্টর-এর উদারীকরণ, যা পরবর্তীতে ভারতকে আউটসোর্সিং হাব বানায়।

বিতর্ক ও চ্যালেঞ্জ:

❎ বাবরি মসজিদ ধ্বংস (১৯৯২):
তাঁর শাসনামলে এই ঘটনার জন্য ভীষণ ভাবে সমালোচিত হন। তিনি এই ঘটনা রোধ করতে ব্যর্থ হন। 
সংস্কারক নীতির বিরোধিতা:
তাঁর সংস্কারগুলির জন্য BJP ও বামদলগুলি কঠোর সমালোচনা করে। যদিও ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর তাঁর শুরু করা সংস্কার নীতি আরও কঠোর ভাবে প্রয়োগ করে।
❎ ১৯৯৬ নির্বাচনে পরাজয়:
কংগ্রেসের ক্ষমতাচ্যুতি হয়, এবং তিনি রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান।  

ব্যক্তিগত জীবন ও মৃত্যু:

- তিনি একজন ‘প্রখর পণ্ডিত’ ছিলেন—সংস্কৃত সাহিত্য, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং (ফরট্রান ভাষায় দক্ষ) এবং ধর্মীয় অধ্যয়নে আগ্রহী।
- ২০০৪ সালে ২৩ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে ‘হৃদরোগে আক্রান্ত’ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।  

ঐতিহাসিক মূল্যায়ন:

ক) ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কারের স্থপতি :

i. ‘ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কারের স্থপতি’ হিসেবে স্বীকৃত। প্রথম দক্ষিণ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যিনি পূর্ণ মেয়াদ সম্পন্ন করেন।  
ii. মনমোহন সিং-এর ভাষায়, “রাও সাহেব না থাকলে ভারতের অর্থনীতি আজও সমাজতন্ত্রের জাঁতাকলে আটকে থাকত।”

iii. তাঁর ‘অসামান্য কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক দূরদর্শিতা’ ভারতকে বিশ্বমঞ্চে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। আজও ভারতীয় রাজনীতিতে তিনি ‘একজন নীরব বিপ্লবী’ হিসেবে স্মরণীয়।

খ) অর্থনৈতিক সংস্কারের সমালোচনা :

বামপন্থী দলগুলি এই সংস্কারের তীব্র বিরোধিতা করেছিল, কারণ, তাদের মতে, এই নীতিগুলি শ্রমিক শ্রেণি এবং দরিদ্র মানুষের স্বার্থের পরিপন্থী ছিল।

i. বেসরকারীকরণের সমালোচনা:

বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়ার ফলে কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতিস্বজনপোষণ দেখা গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া, কিছু ক্ষেত্রে লাভজনক সরকারি সংস্থাগুলিকে কম দামে বেসরকারীকরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে, যা জনগণের সম্পদ অপচয়ের শামিল।

ii. শ্রমিক শ্রেণির উপর প্রভাব:

উদারীকরণ নীতির ফলে অনেক শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন, বিশেষ করে সরকারি ক্ষেত্রে। শ্রমিক সংগঠনগুলি অভিযোগ করে যে, এই নীতিগুলি শ্রমিকদের অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করে।

iii. বৈষম্য বৃদ্ধি: 

কিছু সমালোচকের মতে, এই নীতিগুলি সমাজে বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গরিব মানুষ আরও বেশি করে দারিদ্র্যের শিকার হয়েছে।

iv. বাজার-ভিত্তিক অর্থনীতির সমালোচনা:

কিছু অর্থনীতিবিদের মতে, বাজার-ভিত্তিক অর্থনীতি গ্রহণ করার ফলে ভারতের অর্থনীতি একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হয়েছে। এই নীতিগুলি সমাজের দুর্বল অংশকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

v. বিশ্বায়ন এবং সংস্কৃতির উপর প্রভাব:

বিশ্বায়নের ফলে ভারতীয় সংস্কৃতিঐতিহ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে অনেকে মনে করেন। বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে দুর্বল করে দিচ্ছে।

vi. WTO-তে যোগদান:

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণের ফলে ভারতীয় অর্থনীতি কিছু ক্ষেত্রে বিদেশি বাজারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এর ফলে, দেশের সার্বভৌমত্ব কমেছে বলে মনে করা হয়।

এই সমালোচনাগুলি নরসিমা রাও-এর অর্থনৈতিক সংস্কারের একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ তুলে ধরে। যদিও এই সংস্কারগুলি ভারতের অর্থনীতিকে একটি নতুন পথে চালিত করেছে, তবে এর কিছু নেতিবাচক প্রভাবও ছিল, যা সমালোচকদের আলোচনার বিষয়।
----------xx--------

মন্তব্যসমূহ

🔰 ব্যক্তি অনুযায়ী তথ্য খুঁজুন : 🔍

আরও দেখান

🔰 বিষয় অনুযায়ী তথ্য খুঁজুন :🔍

আরও দেখান

🔰 তথ্য তালাশ : জনপ্রিয় ব্যক্তি ও বিষয়গুলো দেখুন:

উসেইন বোল্ট, ১০০ মিটার দৌড়ে রেকর্ড

ভারতের জাতীয় প্রতীকের নকশাকার

প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ার-এর জন্মদিন

শুভাংশু শুক্লার মহাকাশ পাড়ি

আন্তর্জাতিক সাইকেল দিবস

বিরসা মুন্ডার মৃত্যুদিন

জ্যোতি বসুর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রথম শপথ গ্রহণ

মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা শিবাজীর রাজ্যভিষেক

ভারতে প্রথম জরুরি অবস্থা ঘোষণা

তথ্য তালাশ : অনলাইন সংকলন

আলী হোসেন, লেখক,
তথ্য তালাশ
সুপ্রিয় পাঠক,

তথ্য তালাশ-এর অনলাইন সংকলনে আপনাকে স্বাগত। 

প্রতিদিন, প্রতি নিয়ত বিশ্বজুড়ে ঘটে চলেছে নানান ঘটনা। কিছু বিখ্যাত, কিছু অখ্যাত, আবার কিছু কুখ্যাতও। এই সব হরেক ঘটনার মধ্যে থাকে এমন কিছু ঘটনা, যা মানুষ মনে রাখতে চায়, চায় স্মরণ করতে।

তথ্য তালাশ সেই লক্ষ্য নিয়েই তৈরি। যেহেতু এটি ডিজিটাল ফরম্যাটে তৈরি, তাই যখনই প্রয়োজন পড়বে, আপনার হাতের মোবাইলে হাত রাখলেই আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের মত সামনে হাজির হবে তথ্য তালাশ

আপনি কি পড়তে চান এই সংকলনটি! ক্লিক করুন এখানে