ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি

ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি

The day of Khudiram Bose's hanging,ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি,ক্ষুদিরামের ফাঁসি,
ক্ষুদিরাম বসুর শহীদ দিবস

The day of Khudiram Bose's Hanging

১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট। প্রিঙ্গল কেনেডির স্ত্রী ও কন্যা যে গাড়িতে ছিলেন, তাতে বোমা ছোড়ার অভিযোগে ভোর ৬টার (মতান্তরে ৪ টায়) সময়ে ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি হয়। মৃত্যুর সময়ে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র আঠারো বছর

ক্ষুদিরাম বসু ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয়সর্বকনিষ্ঠ শহীদ বিপ্লবী। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে আত্মাহুতিদানকারী এই বাঙালি যুবকের সাহস ও আত্মত্যাগ আজও দেশবাসীকে অনুপ্রাণিত করে। আজ (১১ আগস্ট, ২০২৫) তাঁর ১১৭তম শাহাদতবার্ষিকী।

ক) জন্ম ও শৈশব: জন্ম:

▪️জন্মস্থান: ১৮৮৯ সালের ৩ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের (তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি) মেদিনীপুর জেলার হাবিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
▪️পিতা-মাতা: ত্রৈলোক্যনাথ বসু ও লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী। শৈশবে মা-বাবা দুজনকেই হারান।
▪️লালন-পালন: বড় বোন অপরূপা দেবী ও তাঁর স্বামীর কাছে। শোনা যায়, দিদি তাঁকে খুদের (চালের গুঁড়ো) বিনিময়ে কিনে নিয়েছিলেন, তাই তাঁর নাম রাখা হয়েছিল ক্ষুদিরাম।
▪️পড়াশোনা : পড়াশোনা তামলুক হ্যামিল্টন স্কুল ও মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে

খ) বিপ্লবী জীবনের সূচনা:

ছোট থেকেই তিনি অত্যন্ত চঞ্চল ও দুঃসাহসী ছিলেন। পড়াশোনায় মনোযোগী হলেও তাঁর মন ছিল দেশ ও দেশের স্বাধীনতার প্রতি। এই সময় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন (১৯০৫) তাঁর মনে গভীর প্রভাব ফেলে। বিপ্লবী সংগঠন ‘যুগান্তর’ দলের সদস্য হন। সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ নেতাদের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হন। গুপ্ত সমিতিতে যোগ দিয়ে বোমা তৈরিব্যবহারের প্রশিক্ষণ নেন। ব্রিটিশদের অত্যাচারী কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে গুপ্তহত্যার মিশনে অংশ নিতে শুরু করেন।

এখানে তিনি লাঠিখেলা, অসি চালনা এবং রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। এই গুপ্ত দলের সদস্য হিসেবে তিনি ব্রিটিশ পণ্য বর্জন ও বিদেশি কাপড় পোড়ানোর মতো বিভিন্ন বিপ্লবী কাজে অংশ নেন।

গ) কিংসফোর্ড হত্যাচেষ্টা

১৯০৮ সালে তৎকালীন কলকাতার প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড বিপ্লবীদের ওপর কঠোর দমন-পীড়ন চালাতেন। ফলে, বিপ্লবীরা তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন। 

লক্ষ্য: 

চার্লস অগাস্টাস কিংসফোর্ড, একজন কুখ্যাত ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি কলকাতায় বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের উপর বিশেষ নিষ্ঠুর দমনপীড়ন চালানোর জন্য কুখ্যাত ছিলেন।

অপারেশন:

যুগান্তর দলের নেতা বারীন্দ্র কুমার ঘোষ এই দায়িত্ব অর্পণ করেন ক্ষুদিরাম বসু এবং প্রফুল্ল চাকীর ওপর।

ঘটনা:

 ৩০ এপ্রিল ১৯০৮ সাল রাতে, মজফফরপুর ইউরোপিয়ান ক্লাবের বাইরে কিংসফোর্ডের গাড়ির মতো দেখতে একটি গাড়ি বের হয়। ভুলবশত ক্ষুদিরাম সেই গাড়িটিতে বোমা নিক্ষেপ করেন, যা মজফফরপুর অপারেশন নামে পরিচিত।

কর্তৃপক্ষ কিংসফোর্ডের বদলি করে তাঁকে বিহারের মুজফফরপুরে পাঠিয়ে দেয়। ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে সেখানে যান। ৩০শে এপ্রিল, ১৯০৮ সালের রাতে তাঁরা কিংসফোর্ডের গাড়ির ওপর বোমা নিক্ষেপ করেন।

ফলাফল:

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সেই গাড়িতে কিংসফোর্ড ছিলেন না। গাড়িতে ছিলেন দুই ব্রিটিশ মহিলা - মিসেস কেনেডি ও তাঁর মেয়ে। বোমা বিস্ফোরণে তাঁরা দুজনই নিহত হন। এই ঘটনা ‘মজফফরপুর অপারেশন’ নামে পরিচিত। কিংসফোর্ড অক্ষত থাকেন। এটি ছিল একটি মর্মান্তিক ভুল।

ঘ) গ্রেপ্তার, বিচার ও ফাঁসি:

কিন্তু ওয়ানি রেলস্টেশনে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ক্ষুদিরাম। আর প্রফুল্ল চাকী ধরা পড়ার আগেই নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেন।

ক্ষুদিরামকে মুজফফরপুর জেলে পাঠানো হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয়। এই মামলার নাম ছিল মুজফফরপুর ষড়যন্ত্র মামলা। বিচার চলাকালীন ক্ষুদিরাম নির্ভয়ে তাঁর অপরাধ স্বীকার করেন এবং হাসিমুখে ফাঁসির আদেশ গ্রহণ করেন। ফাঁসির আদেশ শোনার পর তিনি আইনজীবীকে বলেছিলেন যে, তিনি বোমা তৈরি করতে পারেন।

পলায়ন ও গ্রেপ্তার:

বোমা হামলার পর ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী দুজনেই পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। 

কিন্তু ওয়ানি রেলস্টেশনে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ক্ষুদিরাম। প্রায় ৩০ মাইল হেঁটে যাওয়ার পর, ১ মে সকালে ওয়াইনী রেলস্টেশনে (মজফফরপুর থেকে প্রায় ২৫ কিমি দূরে) এক রেলকর্মীর সন্দেহের কারণে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

আর প্রফুল্ল চাকী ধরা পড়ার আগেই নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেন।

বিচার:

মজফফরপুরে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিচার শুরু হয়। বিচারক ছিলেন মি. কনডো, মি. উডম্যান এবং প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট মি. কক্সক্ষুদিরামের পক্ষে কলকাতার বিশিষ্ট আইনজীবী কালিদাস বসুউপেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখ ছিলেন। এই মামলার নাম ছিল ‘মুজফফরপুর ষড়যন্ত্র মামলা’। বিচার চলাকালীন ক্ষুদিরাম নির্ভয়ে তাঁর অপরাধ স্বীকার করেন এবং হাসিমুখে ফাঁসির আদেশ গ্রহণ করেন। ফাঁসির আদেশ শোনার পর তিনি আইনজীবীকে বলেছিলেন যে, তিনি বোমা তৈরি করতে পারেন।

রায়:

১৩ জুন, ১৯০৮ তারিখে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

আপিল ও শেষ চেষ্টা:

রায়ের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে আপিল করা হয়। বিচারপতি জর্জ ক্লড র্যানাড এবং বিচারপতি ডি.এম. বিচার করেন। বিখ্যাত আইনজীবী নরেন্দ্রকুমার বসু আপিলের পক্ষে যুক্তি দেন। কিন্তু ১৩ জুলাই আপিল খারিজ হয়ে যায়। বাংলাসহ সারা দেশে তাঁর ফাঁসি রদ করার জন্য ব্যাপক জনমত গড়ে উঠেছিল।

ফাঁসি:

১৯০৮ সালের ১১ই আগস্ট, ভোর ৪ টের সময় মুজফফরপুর জেলে ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ফাঁসির সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর, ৭ মাস, ১১ দিন (মতান্তরে, ১৮ বছর ৮ মাস ৮ দিন)। মৃত্যুর সময়ও তিনি সম্পূর্ণ নির্ভীক ও দৃপ্ত ছিলেন। কথিত আছে, তিনি হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে উঠেছিলেন এবং তাঁর শেষ ইচ্ছা ছিল ‘বন্দে মাতরম’ শুনতে। তাঁর লাশ গোপনে দাফন করা হয়, কিন্তু পরবর্তীতে জনরোষের ভয়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তা জেলের কাছে উদ্ধার করে হিন্দু রীতি অনুযায়ী সৎকারের অনুমতি দেয়।

ঙ) ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও উত্তরাধিকার:

1. সর্বকনিষ্ঠ শহীদ:

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ফাঁসিকাষ্ঠে শহীদ হওয়া সর্বকনিষ্ঠ বিপ্লবী হিসেবে ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।

2. বিপ্লবের প্রতীক:

তাঁর আত্মত্যাগ সারা দেশে, বিশেষ করে তরুণ সমাজে, ব্রিটিশ বিরোধী চেতনাকে তীব্রভাবে প্রজ্বলিত করে। "ক্ষুদিরাম" নামটি হয়ে ওঠে সাহস ও দেশপ্রেমের প্রতীক।

3. জনপ্রিয় সংস্কৃতি:

তাঁর জীবন ও আত্মত্যাগ অসংখ্য গান, কবিতা, নাটক, উপন্যাস ও চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু হয়েছে। বাংলা লোকসংগীতে বিশেষ করে তাঁর বীরত্বগাথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত (যেমন: "একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি..." গানটি তাঁর স্মরণেই রচিত)।

4. স্মৃতিসৌধ:

মজফফরপুরে তাঁর ফাঁসির স্থানে (বর্তমানে শহরের কেন্দ্রস্থল) ক্ষুদিরাম বসু স্মৃতিসৌধ ও পার্ক নির্মিত হয়েছে। হাবিবপুরে (জন্মস্থান) এবং মেদিনীপুরেও তাঁর স্মৃতিরক্ষার ব্যবস্থা আছে।

5. প্রেরণা:

ক্ষুদিরামের জীবন ও মৃত্যু পরবর্তী প্রজন্মের বিপ্লবীদের (ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ প্রমুখ) জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়ায়।

চ) মূল্যায়ন:

ক্ষুদিরাম বসু ছিলেন অদম্য সাহস, অকৃত্রিম দেশপ্রেম এবং তরুণ উৎসর্গের জীবন্ত প্রতীক। ভুল লক্ষ্যে নিরপরাধ নারী ও শিশুর মৃত্যু তাঁর অপারেশনের একটি করুণ ও বিতর্কিত দিক, কিন্তু ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহের চেতনা এবং মাত্র ১৮ বছর বয়সে মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করার অতুলনীয় সাহস তাঁকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি অনন্য ও গৌরবময় স্থান দিয়েছে। আজও ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগ বাঙালি ও সমগ্র ভারতবাসীর কাছে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়

এত অল্প বয়সে দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া এই তরুণ বিপ্লবী ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাঁর আত্মত্যাগ ভারতের যুবসমাজকে অনুপ্রাণিত করে এবং স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তোলে।

ফাঁসির পর তাঁর দেহ জেলের বাইরে আনা হলে হাজার হাজার মানুষ ‘বন্দেমাতরম’ স্লোগান দিয়ে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানায়। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ক্ষুদিরাম বসুর নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। তাঁর বলিদান আজও দেশের প্রতি ভালোবাসা ও ত্যাগের এক অনন্য উদাহরণ।
--------xx-------

মন্তব্যসমূহ

🔰 ব্যক্তি অনুযায়ী তথ্য খুঁজুন : 🔍

আরও দেখান

🔰 বিষয় অনুযায়ী তথ্য খুঁজুন :🔍

আরও দেখান

🔰 তথ্য তালাশ : জনপ্রিয় ব্যক্তি ও বিষয়গুলো দেখুন:

উসেইন বোল্ট, ১০০ মিটার দৌড়ে রেকর্ড

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের জন্মদিন

শুভাংশু শুক্লার মহাকাশ পাড়ি

ভারতের জাতীয় প্রতীকের নকশাকার

প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ার-এর জন্মদিন

জ্যোতি বসুর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রথম শপথ গ্রহণ

আন্তর্জাতিক সাইকেল দিবস

বিরসা মুন্ডার মৃত্যুদিন

মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা শিবাজীর রাজ্যভিষেক

তথ্য তালাশ : অনলাইন সংকলন

আলী হোসেন, লেখক,
তথ্য তালাশ
সুপ্রিয় পাঠক,

তথ্য তালাশ-এর অনলাইন সংকলনে আপনাকে স্বাগত। 

প্রতিদিন, প্রতি নিয়ত বিশ্বজুড়ে ঘটে চলেছে নানান ঘটনা। কিছু বিখ্যাত, কিছু অখ্যাত, আবার কিছু কুখ্যাতও। এই সব হরেক ঘটনার মধ্যে থাকে এমন কিছু ঘটনা, যা মানুষ মনে রাখতে চায়, চায় স্মরণ করতে।

তথ্য তালাশ সেই লক্ষ্য নিয়েই তৈরি। যেহেতু এটি ডিজিটাল ফরম্যাটে তৈরি, তাই যখনই প্রয়োজন পড়বে, আপনার হাতের মোবাইলে হাত রাখলেই আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের মত সামনে হাজির হবে তথ্য তালাশ

আপনি কি পড়তে চান এই সংকলনটি! ক্লিক করুন এখানে