ভারতে প্রথম জরুরি অবস্থা ঘোষণা
ভারতে প্রথম জরুরি অবস্থা ঘোষণা
First state of emergency declared in India
১৯৭৫ সালের ২৫ জুন। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে আজকের দিনে স্বাধীন ভারতে প্রথম জারি হয়েছিল জরুরি অবস্থা। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। মন্ত্রিসভার অনুমোদন ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কথাতেই জরুরি অবস্থার অর্ডিন্যান্স-এ সই করেছিলেন রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলী আহমেদ।জরুরি অবস্থা নিয়ে লেখা শ্রীনাথ রাঘবন তাঁর ‘ইন্দিরা গান্ধী এন্ড দ্য ইয়ার্স দ্যাট ট্রান্সফর্মড ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে বিস্তারিত তথ্য সহযোগে দেখিয়েছেন কেন ইন্দ্রিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন।
তিনি মূলত চারটি টি বিষয় ইন্দিরা গান্ধীর এই সিদ্ধান্তের পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল বলে উল্লেখ করেছেন।
- বিরোধীরা (জয়প্রকাশ নারায়ণ) ভোটে না জিতেও সংসদ বহির্ভূত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা,
- আরএসএস ও জনসংঘের মতো সংগঠনের ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্র। ইন্দিরা গান্ধী মনে করতেন, ১৯৭৩ সালে চিলির প্রেসিডেন্ট সালভাদোর আলেন্দেকে হত্যা করা হয়েছিল তাঁকেও সেভাবেই মেরে ফেলতে চায়।
- আমেরিকান ষড়যন্ত্র :
- বিরোধী দলের নেতাদের বিভিন্ন ভাষণ।
- দিল্লিতে ২৫ শে জুনের ‘জন মোর্চা’র ডাকে আয়োজিত জনসভায় ‘লোক সংঘর্ষ সমিতি’ গঠন ও তার ঘোষিত উদ্দেশ্য।
আর এস এস এর ভূমিকা :
ইন্দিরা গান্ধী করতেন আরএসএসের মতাদর্শ ফ্যাসিবাদের ‘ক্লোন’। তিনি তাঁর পিতা জহরলাল নেহেরুকে ১৯৪৭ সালে লিখেছিলেন, আরএসএস-এর সঙ্গে আশ্চর্যজনকভাবে ইউরোপের ব্রাউন শাট আন্দোলনের মিল রয়েছে। ভারত সাবধান না হলে এই শক্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
ইন্দিরা গান্ধী অভিযোগ করেছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণের দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের পিছনে মূল শক্তি হল আরএসএস। তাঁর এই অভিযোগের প্রতিবাদে জয়প্রকাশ নারায়ণ জনসংঘের সভায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, তাহলে তিনি নিজেও একজন ফ্যাসিস্ট।
১৯৭৩ সালে সেপ্টেম্বরে চিলিতে যখন প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দেকে হত্যা করা হল তখন ইন্দিরা গান্ধী তাঁর বন্ধু ফিদেল কাস্ত্রকে বলেছিলেন, ‘ওরা আমাকেও ঠিক এইভাবে মারতে চায়’। লক্ষণীয় বিষয় হল, ১৯৭৫ সালে জানুয়ারিতে বিহারে বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভার সদস্য এবং দলের মূল তহবিল সংগ্রহকারী এলএন মিশ্রকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনা ইন্দিরা গান্ধীকে আতঙ্কিত করে তোলে এবং আরএসএস সম্পর্কে তার ধারণা আরও দৃঢ় হয়।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা :
এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ভারতের ভূমিকা আমেরিকার পছন্দ ছিল না। তারা ইন্দিরা গান্ধীকে এ বিষয়ে যে পরামর্শ দিয়েছিলেন। পরামর্শ দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী তা সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ফলে, মার্কিন প্রশাসন ইন্দিরা গান্ধীর উপর চাপ বাড়াতে থাকে, যার সঙ্গে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের গভীর সম্পর্ক আছে বলে তিনি ধারণা করেন। বিশ্বব্যাপী আমেরিকার পরামর্শ অমান্যকারীদের সঙ্গে যে ধরনের নীতি গ্রহণের নজির তারা তৈরি করেছে, তা থেকেই ইন্দিরা গান্ধীর এই ধারণা হয়।
বিরোধী নেতাদের বিভিন্ন বক্তব্য :
জরুরি অবস্থা জারির মতো সিদ্ধান্তের পিছনে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বিভিন্ন ভাষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
লাল কৃষ্ণ আদবানি :
১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে জনসংঘের জেনারেল কাউন্সিলের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় বক্তৃতা দেয়ার সময় লাল কৃষ্ণ আদ্ভানি বলেছিলেন, সংবিধান বহির্ভূত পথে নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটানো সম্পূর্ণ বৈধ।
অটল বিহারী বাজপেয়ী :
১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে বাজপেয়ী ঘোষণা করেন, সরকার দুষ্কর্ম আড়াল করতে সংসদকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছে। এর প্রতিবাদ শুধু সংসদীয় পথে হতে পারে না।
মুরারজি দেশাই :
মরার কি দেশাইকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ইন্দিরাতে সরাতে তিনি কেন পরের নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন না। সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের জবাবে মোরারজি দেশাই বলেছিলেন, লোহা গরম থাকতেই আঘাত করার উপযুক্ত সময়, তাছাড়া ইন্দিরাকে ভোটে হারানো খুবই কঠিন কাজ।
ইএমএস নামবুদিরিপাদ :
এ বিষয়ে ই এম এস নামবুদিরিপাদের বক্তব্য ছিল এইরকম : সমস্ত বিষয়ের সমাধান সাংবিধানিক পথেই হবে, এমনটা তারা মনে করেন না।
জয়প্রকাশ নারায়ণ :
১৯৭৫ সালের ২৫ জুন জনম মোর্চার ডাকে সংঘটিত জনসভায় জয়প্রকাশ নারায়ণ সেনাবাহিনী পুলিশ এবং সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, তারা যেন সরকারের অন্যায় নির্দেশ অমান্য করেন। ইন্দিরা গান্ধীর কাছে এই ঘোষণা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বলে মনে হয়েছিল, যা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক।
লোক সংঘর্ষ সমিতি গঠন :
ঠিক এইরকম পরিস্থিতিতে, ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন দিল্লিতে জন মোর্চার ডাকে একটি বিরাট জনসভা আয়োজিত হয়। এই জনসভায় ইন্দিরা গান্ধীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করানোর জন্য লোক সংঘর্ষ সমিতি গঠনের কথা ঘোষণা করেন। এই সমিতির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন মোরাচি দেশাই। সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন আরএসএস এর শীর্ষনেতা এবং জনসংঘের অর্গানাইজিং সেক্রেটারি নানাজী দেশমুখ। এই এই সভা থেকেই ২৯ শে জুন দেশ জুড়ে সত্যাগ্রহের ডাক দেয়া হয়। পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা করা হয়, লক্ষ লক্ষ মানুষ ইন্দিরা গান্ধীর বাড়ি ঘেরাও করবেন, যাতে তিনি বাড়ি থেকে বেরোতে না পারেন।
জরুরি অবস্থা ঘোষণা :
দেশি এবং বিদেশি এই সমস্ত ঘটনা পরম্পরায় ইন্দিরা গান্ধীর মনে এই ধারণা দৃঢ়মূল হয়েছিল যে, বিরোধী দলগুলো তাঁকে ক্ষমতাকচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করছে। শুধু তাই নয়, তাঁর বিশ্লেষণে, এ কাজ বিরোধীরা অগণতান্ত্রিক পথেই করবে এবং এক্ষেত্রে তাঁর জীবন সংশয়েরও আশঙ্কা রয়েছে। মূলত এই পটভূমিতে ইন্দিরা গান্ধী সংবিধানের ৩৫২ ধারা জারি করে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন।
কিন্তু মজার কথা হল, অগণতান্ত্রিক শক্তিকে রুখতে তিনি যে পথ নিয়েছিলেন, সেটাও ছিল অগণতান্ত্রিক। কারণ,
- ১) জরুরি অবস্থা তখনই জারি করা যায়, যখন দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়। কিন্তু তেমন কোন রিপোর্ট ইন্দিরা গান্ধীর সরকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলী আহমেদের কাছে পাঠাননি।
- ২) এমনকি সংবিধান অনুযায়ী, মন্ত্রিসভার অনুমোদন নেওয়ার যে নিয়ম রয়েছে তাও তিনি পালন করেননি।
- ৩) মন্ত্রিসভার অনুমোদন ছাড়াই রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণার অর্ডিন্যান্সে সই করেছিলেন।
আর এ কারণেই শ্রীনাথ রাঘমন তাঁর গ্রন্থে (‘ইন্দিরা গান্ধী এন্ড দ্য ইয়ার্স দ্যাট ট্রান্সফর্মড ইন্ডিয়া’) জরুরি অবস্থাকে বেআইনি বলে অভিহিত করেছেন।
মূলত এই পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন রাতে মন্ত্রিসভার অনুমোদন ছাড়াই ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করেন। যদিও, পরের দিন সকাল ছটায় ইন্দিরা গান্ধীর বাড়িতে ডাকা মন্ত্রিসভার বৈঠকে জরুরি অবস্থা ঘোষণার অনুমোদন নেওয়া হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন