তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠন
তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠন
Formation of Telangana State
২০১৪ সালের ২রা জুন। এই দিন গঠিত হয় তেলেঙ্গানা রাজ্য। অন্ধ্রপ্রদেশের ১০ টি জেলা নিয়ে এই রাজ্য গঠিত হয়। রাজধানী হয় হায়দ্রাবাদ। বর্তমানে ৩৩ টি জেলা রয়েছে এই রাজ্যে। সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে পৃথক রাজ্যের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালানোর পর ২০১৪ সালে তেলেঙ্গানা রাজ্যের আত্মপ্রকাশ।
তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠন ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ২০১৪ সালে অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য থেকে পৃথক হয়ে তেলেঙ্গানা ভারতের ২৯তম রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর পটভূমি ও তাৎপর্য নিম্নরূপ:
পটভূমি:
1. ঐতিহাসিক বিভাজন:
তেলেঙ্গানা ঐতিহাসিকভাবে হায়দ্রাবাদ রাজ্যের অংশ ছিল, যা ১৯৪৮ সালে ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়। ১৯৫৬ সালে রাজ্য পুনর্গঠন আইনের মাধ্যমে হায়দ্রাবাদ রাজ্যের তেলুগুভাষী অঞ্চল (তেলেঙ্গানা) অন্ধ্রপ্রদেশের সাথে যুক্ত হয়।
এই একত্রীকরণের শর্ত ছিল ‘জেন্টলমেন্স এগ্রিমেন্ট’, যাতে তেলেঙ্গানার স্বার্থ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।
2. অসন্তোষ ও আন্দোলন:
তেলেঙ্গানা অঞ্চলটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ে। স্থানীয় জনগণ অনুভব করেছিলেন যে অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলি উন্নয়নের সুবিধা পাচ্ছে, কিন্তু তেলেঙ্গানা উপেক্ষিত হচ্ছে।
১৯৬৯ সালে প্রথম তেলেঙ্গানা আন্দোলন হয়, কিন্তু তা দমন করা হয়। ২০০১ সালে তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি (TRS) গঠনের মাধ্যমে আন্দোলন নতুন গতি পায়।
3. রাজনৈতিক চাপ ও সমর্থন:
২০০৯ সালে TRS নেতা কে. চন্দ্রশেখর রাও (KCR) অনশন শুরু করলে কেন্দ্রীয় সরকার তেলেঙ্গানা গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করে।
দীর্ঘ আলোচনা ও রাজনৈতিক জটিলতার পর, ২০১৪ সালের ২ জুন তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের আইন পাস হয় এবং ২ জুন ২০১৪ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। হায়দ্রাবাদকে ১০ বছরের জন্য যৌথ রাজধানী (তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশ) হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।
তাৎপর্য:
1. ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি:
তেলুগু ভাষার দুটি প্রধান উপভাষা (তেলেঙ্গানা ও উপকূলীয় অন্ধ্র) ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠন হয়। তেলেঙ্গানার স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
2. রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন:
স্থানীয় জনগণের উন্নয়ন নীতিতে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। তেলেঙ্গানার নিজস্ব সরকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতিগুলি প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়।
3. অর্থনৈতিক সুবিধা:
রাজ্য গঠনের পর তেলেঙ্গানা দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি করে, বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তি (হায়দ্রাবাদ), কৃষি (সিংাচলম মরুভূমি সেচ প্রকল্প) ও শিল্পখাতে।
4. ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো:
এটি ভারতের নমনীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উদাহরণ, যেখানে ভাষা, সংস্কৃতি ও আঞ্চলিক স্বার্থের ভিত্তিতে নতুন রাজ্য গঠন সম্ভব।
5. অন্ধ্রপ্রদেশের প্রভাব:
তেলেঙ্গানা বিভাজনের পর অন্ধ্রপ্রদেশ নতুন রাজধানী (অমরাবতী) গঠন ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়।
সমালোচনা:
কিছু বিশ্লেষক যুক্তি দেন যে ছোট রাজ্য গঠন দীর্ঘমেয়াদে প্রশাসনিক ব্যয় বাড়ায় এবং আঞ্চলিক বিবাদ সৃষ্টি করতে পারে (যেমন, হায়দ্রাবাদের মালিকানা নিয়ে বিতর্ক)।
উপসংহার:
তেলেঙ্গানা গঠন ভারতের আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের সংবেদনশীলতার প্রতীক। এটি স্থানীয় জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করলেও ভবিষ্যতে এর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে।
---------
তেলেঙ্গানা ভারতের ২৯তম রাজ্য, যা ২ জুন ২০১৪ সালে অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে আলাদা হয়ে গঠিত হয়। এর রাজধানী হল হায়দ্রাবাদ। তেলেঙ্গানার এই রাজ্য গঠনের পেছনে দীর্ঘদিনের আন্দোলন ও ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে।
পটভূমি:
হায়দ্রাবাদ রাজ্যের অংশ:
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সময় তেলেঙ্গানা অঞ্চলটি হায়দ্রাবাদ দেশীয় রাজ্যের অংশ ছিল, যা নিজামের শাসনাধীন ছিল। ১৯৪৮ সালে 'অপারেশন পোলো'র মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দ্রাবাদ রাজ্যকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করে।
ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন:
১৯৫৩ সালে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠিত হয়। তেলেঙ্গানা অঞ্চলটি তেলেগুভাষী হওয়ায় অনেকে একে অন্ধ্র রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করার দাবি জানায়। তবে কমিশন প্রাথমিকভাবে তেলেঙ্গানাকে পৃথক রাজ্য রাখার পক্ষে মত দেয়, কারণ তেলেঙ্গানাবাসীর আশঙ্কা ছিল যে তাদের রাজস্বের অতিরিক্ত ভাগ অন্যত্র চলে যাবে এবং সেচ প্রকল্পেও তারা কম সুযোগ পাবে।
অন্ধ্রপ্রদেশের সাথে সংযুক্তি:
১৯৫৬ সালে রাজ্য পুনর্গঠন আইন (State Reorganisation Act, 1956) এর মাধ্যমে হায়দ্রাবাদ রাজ্যের তেলেগুভাষী অঞ্চলগুলি অন্ধ্র রাজ্যের সঙ্গে একীভূত হয়ে বৃহত্তর অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য গঠিত হয়। এর ফলে তেলেগুভাষী সকল মানুষ এক রাজ্যে আসে।
পৃথক তেলেঙ্গানার জন্য আন্দোলন:
অন্ধ্রপ্রদেশের সাথে যুক্ত হওয়ার পর থেকেই তেলেঙ্গানা অঞ্চলে বৈষম্যের অভিযোগ ওঠে। তাদের অভিযোগ ছিল, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তেলেঙ্গানার মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে ১৯৬৯, ১৯৭২ এবং ২০০৯ সালে বড় ধরনের আন্দোলন হয়। বিশেষ করে ১৯৬৯ সালের 'জয় তেলেঙ্গানা' আন্দোলন এবং পরে কে. চন্দ্রশেখর রাওয়ের নেতৃত্বে তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি (TRS) গঠনের পর এই আন্দোলন আরও তীব্র হয়। ২০০৯ সালে কে. চন্দ্রশেখর রাওয়ের অনশন ধর্মঘট আন্দোলনকে এক নতুন মাত্রা দেয়।
রাজ্য গঠন:
দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলস্বরূপ, ২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর ভারত সরকার পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের প্রক্রিয়া শুরুর ঘোষণা দেয়। এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সংসদীয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে:
- ২০১৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি লোকসভা তেলেঙ্গানা বিল পাস করে।
- ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাজ্যসভায় বিলটি পাস হয়।
- ২০১৪ সালের ১ মার্চ রাষ্ট্রপতি বিলটিতে সম্মতি দেন।
- অবশেষে, ২০১৪ সালের ২ জুন তেলেঙ্গানা ভারতের ২৯তম রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। হায়দ্রাবাদ শহরটি ১০ বছরের জন্য তেলেঙ্গানা এবং অবশিষ্টাংশ অন্ধ্রপ্রদেশের যৌথ রাজধানী হিসেবে নির্ধারিত হয়।
তাৎপর্য:
আঞ্চলিক পরিচয় ও স্বায়ত্তশাসন:
তেলেঙ্গানা গঠনের প্রধান তাৎপর্য হল আঞ্চলিক পরিচয় এবং স্বায়ত্তশাসনের প্রতিষ্ঠা। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয়ের দাবি মেনে নেওয়ায় স্থানীয় জনগণের মধ্যে সন্তুষ্টি আসে।
উন্নয়নের সুযোগ:
পৃথক রাজ্য হিসেবে তেলেঙ্গানা তার নিজস্ব অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। এতে অনুন্নত অঞ্চলগুলোর দিকে বিশেষ নজর দেওয়া সম্ভব হয়।
রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব:
তেলেঙ্গানা গঠনের ফলে সেখানকার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব আরও শক্তিশালী হয় এবং তারা নিজেদের অঞ্চলের সমস্যাগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তুলে ধরতে পারে।
কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি:
তেলেঙ্গানা গঠন ভারতের রাজ্য পুনর্গঠন নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। এটি দেখায় যে, দীর্ঘদিনের জনআকাঙ্ক্ষা এবং শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন রাজ্য গঠন সম্ভব।
আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন:
তেলেঙ্গানা গঠনের পর পরিকাঠামো উন্নয়ন, শিল্পায়ন এবং কৃষিক্ষেত্রে নতুন করে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়, যা রাজ্যের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সহায়ক হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন