মাতঙ্গিনী হাজরার শহীদ দিবস
মাতঙ্গিনী হাজরার শহীদ দিবস :
Martyrdom Day of Matangini Hazra
১৯৪২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। স্বাধীনতা সংগ্রামী মাতঙ্গিনী হাজরার শহীদ দিবস। ১৯৪২ সালের আজকের দিনে তিনি পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। বর্তমান মেদিনীপুরের তমলুক শহরে প্রায় ছয় হাজার মানুষের একটি মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই বীরাঙ্গনা নারী। গান্ধীজীর ডাকা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সমর্থনে তিনি এই মিছিলের ডাক দিয়েছিলেন। মিছিল চলাকালীন পুলিশ তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। তিনি শহীদ হন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭২ বছর।
আরও পড়ুন :
মাতঙ্গিনী হাজরার জন্ম, বংশ পরিচয় ও পারিবারিক জীবন।
ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক মহকুমা) অন্তর্গত হোগলা গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
১. মুখবন্ধ: স্বাধীনতা সংগ্রামে মাতঙ্গিনী হাজরার স্থান ও মেদিনীপুরের প্রেক্ষাপট
১.১. বাংলার নারী নেতৃত্বের প্রদীপ্ত প্রতীক: পরিচিতি ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব
মাতঙ্গিনী হাজরা (১৮৬৯/১৮৭০–১৯৪২) ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী নারী চরিত্র। তাঁর মানবতাবাদী আদর্শ ও অহিংস আন্দোলনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, তাঁকে গান্ধীবাদী নেত্রী হিসেবে ভারতীয় জনমানসে অমর করে রেখেছে।তাঁর রাজনৈতিক সক্রিয়তা কেবল আইন অমান্য আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং ১৯৪২ সালের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময় তিনি যে তেজস্বিতা ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন, তা তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।
স্বাধীনতার দীর্ঘ বছর পরে, ১৯৭৭ সালে কলকাতায়, স্বাধীন ভারতে প্রথম একজন নারী মূর্তি স্থাপন করা হল। আর যিনি স্থাপিত হলেন, তিনি সেই মহীয়সী নারী, যার নাম মাতঙ্গিনী হাজরা। সমাজের প্রান্তিক স্তর থেকে উঠে আসা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বঞ্চিত, একজন গ্রামীণ নারীর এই জাতীয় সম্মান এটাই প্রমাণ করে যে, তাঁর প্রতীকী মূল্য শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি সমাজের দুর্বলতম অংশের মানুষের কাছে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের চূড়ান্ত এবং সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর এই মর্যাদা ও সম্মান বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের তৃণমূল স্তরের শক্তির গভীরতাকেই নির্দেশ করে।
মেদিনীপুরের বিপ্লবীদের ক্ষোভ কেবল আইন অমান্য বা প্রতীকী প্রতিরোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁদের লক্ষ্য ছিল সুদূরপ্রসারী—ব্রিটিশদের উৎখাত করে স্থানীয়ভাবে ভারতীয়দের একটি সমান্তরাল সরকার স্থাপন করা। এই পরিকল্পনা নির্দেশ করে যে মেদিনীপুরের আন্দোলন একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার চেয়েও বেশি কিছু ছিল; এর পেছনে ছিল এক গভীর সাংগঠনিক কাঠামো এবং স্থানীয়ভাবে ক্ষমতা দখলের সুচিন্তিত রণনীতি।
কিন্তু এই বিবাহিত জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মাত্র ১৮ বছর বয়সে, কোনো সন্তান ছাড়াই তিনি বিধবা হন । বিধবা হওয়ার পর তিনি তাঁর পৈতৃক গ্রামে ফিরে আসেন এবং দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন শুরু করেন। সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও, মাতঙ্গিনী জীবনের এই কঠোরতাগুলিকে অতিক্রম করার জন্য আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
মাতঙ্গিনী ছিলেন সামাজিক দিক থেকে দুর্বল—নিরক্ষর, বিধবা এবং দরিদ্র কৃষক পরিবারের কন্যা। এই প্রেক্ষাপটে, তাঁর সমাজসেবামূলক কাজগুলি তাঁকে স্থানীয় সমাজে গভীর রাজনৈতিক বৈধতা এনে দেয়। এই নৈতিক পুঁজিই তাঁকে পরবর্তীকালে হাজার হাজার মানুষের নেতৃত্ব দেওয়ার সাহস ও অধিকার জুগিয়েছিল, যা আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত বা উচ্চবর্গীয় নেতৃত্বের অভাবকে অতিক্রম করে গিয়েছিল। জনগণের সেবায় তাঁর এই নিবেদন তাঁকে সাধারণ মানুষের অত্যন্ত কাছের করে তুলেছিল ।
গান্ধীজীর নীতির প্রতি তাঁর এই অটল প্রতিশ্রুতির কারণে জনগণ তাঁকে স্নেহভরে ‘গান্ধী বুড়ি’ (বৃদ্ধা গান্ধী) নামে ডাকত। এই উপাধিটি কেবল তাঁর বয়সকেই নির্দেশ করে না, বরং এটি তাঁর আদর্শিক আনুগত্যকেও তুলে ধরে। মেদিনীপুরের মতো একটি অঞ্চলে, যেখানে সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের প্রভাবও ছিল, সেখানে একজন কট্টর গান্ধীবাদীর এমন জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে যে, অহিংসার আদর্শ তৃণমূল পর্যায়ে গভীর শিকড় গেড়েছিল। এই আদর্শিক ভিত্তিই তাঁকে ১৯৪২ সালের চূড়ান্ত সংঘর্ষের সময় অহিংসার পথে অটল থাকতে সাহায্য করেছিল।
একই বছর, অর্থাৎ ১৯৩৩ সালে, তাঁর সাহসিকতার এক চরম পরীক্ষা দেখা যায়। বাংলার গভর্নর স্যার জন অ্যান্ডারসন যখন তমলুক পরিদর্শনে আসেন, তখন মাতঙ্গিনী কৌশলে নিরাপত্তা এড়িয়ে মঞ্চে পৌঁছে যান এবং গভর্নরের সামনে কালো পতাকা নাড়িয়ে দেন। এটি ছিল প্রতীকীভাবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্তৃত্বকে সরাসরি অস্বীকার করার চরমতম উদাহরণ। এই নির্ভীক কাজের জন্য তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হয় এবং ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয় ।
তাঁর ৬০ বছর বয়সে রাজনৈতিক জীবনে সূচনা এবং গভর্নরের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ তাঁকে স্থানীয় জনগণের চোখে কেবল একজন কর্মী হিসেবে নয়, বরং একজন নির্ভীক, সরকারের চোখে চোখ রাখা নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। তাঁর এই বিলম্বিত কিন্তু তীব্র শুরু গ্রামীণ বয়স্ক মহিলাদের জন্য একটি শক্তিশালী উদাহরণ তৈরি করে, যা ১৯৪২ সালে তাঁর নেতৃত্বে বিশাল জনসমাবেশে প্রতিফলিত হয়েছিল।
মাতঙ্গিনী হাজরার রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ নিম্নলিখিত সারণীতে তুলে ধরা হলো:
মাতঙ্গিনী হাজরার রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ (১৯৩০-১৯৪২)
সময়কাল
আন্দোলনের নাম
মাতঙ্গিনী হাজরার ভূমিকা
ফলাফল
উৎস
১৯৩০ (৬০ বছর বয়সে)
আইন অমান্য আন্দোলন (লবণ সত্যাগ্রহ)
আলিনানে লবণ উৎপাদন, আইন ভঙ্গ, কংগ্রেসে যোগদান
প্রথমবার গ্রেপ্তার ও মুক্তি
১৯৩২
চৌকিদারি কর বন্ধ আন্দোলন
বেআইনি আদালতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
ছয় মাস কারাদণ্ড ও বহরমপুর জেলে প্রেরণ
১৯৩৩
গভর্নরের প্রতি প্রতিবাদ
বাংলার গভর্নর স্যার জন অ্যান্ডারসনের সামনে কালো পতাকা প্রদর্শন
ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ড
২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪২ (৭২/৭৩ বছর বয়সে)
ভারত ছাড়ো আন্দোলন (তমলুক থানা অভিযান)
৬,০০০ মানুষের শোভাযাত্রার নেতৃত্ব, পতাকা উত্তোলন
ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে শহীদ
বিপ্লবী কর্মকাণ্ডর জন্য জেলবন্দি থাকার পরও জেল থেকে ছাড়া পেয়েই মাতঙ্গিনী মানুষের সেবায় ছুটে যেতেন । এই কারণেই তিনি জনগণের খুবই কাছের ছিলেন। শোভাযাত্রার একেবারে সম্মুখে তিনি হাতে ত্রিবর্ণ জাতীয় পতাকা ধারণ করে এগিয়ে চলছিলেন। এই সময়ে একটি বৃদ্ধা নারীর নিজে মিছিলের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া ছিল অবিশ্বাস্য, যা ভাবলে মনে হয় কল্পকাহিনি, কিন্তু বাস্তব মাঝে মাঝে কল্পনার থেকেও এগিয়ে থাকে ।
তমলুকের স্থানীয় নেতারা, মাতঙ্গিনী সহ, জানতেন যে এই আন্দোলন কেবল ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়, এটি একটি সংগঠিত বিপ্লব। তাদের এই কৌশলই সরাসরি তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি তৈরি করেছিল । এই অভিযান প্রমাণ করে যে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে মেদিনীপুরের বিপ্লবীরা সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত ছিলেন, যার ফলস্বরূপ মাতঙ্গিনী তাঁর জীবন উৎসর্গ করেন।
মাতঙ্গিনী হাজরা পুলিশের হুঙ্কার শুনে দমে যাননি। তিনি হাতে জাতীয় পতাকা উঁচু করে ধরে এগিয়ে যেতে থাকেন, তাঁর চোখেমুখে কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না । তিনি তাঁর গান্ধীবাদী আদর্শের প্রতি অটল থেকে, অহিংস পথে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তিনি মরণকে আলিঙ্গন করেছিলেন এই বিশ্বাসে যে, ‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান’ ।
বিপ্লবী সংবাদপত্র ‘বিপ্লবী’ অনুযায়ী, তিনি যখন এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন পুলিশ তাঁকে লক্ষ্য করে তিনবার গুলি চালায় ।
প্রথম গুলি: প্রথম গুলিটি মাতঙ্গিনীর বামহাতের কনুইয়ে বিদ্ধ হয়। এই আঘাতে তাঁর হাত থেকে শাঁখ পড়ে যায়, কিন্তু তিনি আঘাতের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে জাতীয় পতাকা নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন ।
দ্বিতীয় গুলি: দ্বিতীয় গুলিটি এসে তাঁর ডান হাতের কনুইয়ে লাগে। কিন্তু এই আঘাত সত্ত্বেও তিনি পতাকা ছাড়েননি ।
তৃতীয় ও চূড়ান্ত গুলি: চূড়ান্ত মুহূর্তে তৃতীয় গুলিটি এসে তাঁর কপালে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে ৭২/৭৩ বছর বয়সী এই বীরাঙ্গনা নারীর দেহটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
মাতঙ্গিনী যদিও সরকার প্রতিষ্ঠার আগেই শহীদ হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর বলিদান নিশ্চিত করেছিল যে জনগণের ক্রোধ ব্রিটিশ প্রশাসনকে উৎখাত করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠবে। তাঁর মৃত্যু জনরোষকে সংগঠিত করার জন্য একটি কেন্দ্রবিন্দু বা Catalyst হিসেবে কাজ করে। এই সরকার গঠনে সতীশচন্দ্র সামন্ত, সুশীল কুমার ধাড়া, অজয় মুখোপাধ্যায় এবং মাতঙ্গিনী হাজরা প্রধান নেতা হিসেবে ভূমিকা পালন করেন ।
নেতৃত্ব ও প্রশাসন: বিপ্লবী সতীশচন্দ্র সামন্ত সর্বাধিনায়ক হন। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজয় কুমার মুখোপাধ্যায় অর্থসচিব এবং সুশীল কুমার ধাড়া সমর ও স্বরাষ্ট্রসচিবের দায়িত্ব পালন করেন ।
শাসনব্যবস্থা ও কার্যক্রম: TJS পৃথক শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, যার মধ্যে ছিল আইন-শৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিচার, কৃষি, প্রচার, সমর ইত্যাদি বিভাগ । এই সরকারের নিজস্ব মুখপত্র, ‘বিপ্লবী’, প্রকাশিত হত । এই জাতীয় সরকার ঘূর্ণিঝড়-বিধ্বস্ত এলাকায় ত্রাণকার্যও চালায়, যা জনগণের মধ্যে তাদের বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল ।
বিলুপ্তি: তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার সফলভাবে প্রায় দুই বছর কাজ করেছিল এবং ১৯৪৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কার্যকর ছিল। অবশেষে, মহাত্মা গান্ধীর নির্দেশে ১৯৪৪ সালের ৮ আগস্ট এই সরকার বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় ।
মাতঙ্গিনীর আত্মত্যাগ এবং তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার মধ্যে থাকা কার্যকারণ সম্পর্ক নিম্নোক্ত সারণীতে স্পষ্ট:
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা ও মাতঙ্গিনী হাজরার প্রভাব
ঘটনা
তারিখ
তাৎপর্য ও প্রভাব
উৎস
মাতঙ্গিনী হাজরার শহীদত্ব লাভ
২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪২
তমলুক থানা দখলের প্রচেষ্টার সময় মৃত্যু, আন্দোলনের জন্য চরম প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গঠিত
১৭ ডিসেম্বর, ১৯৪২
মাতঙ্গিনীর আত্মত্যাগের প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ, ব্রিটিশ শাসনকে উৎখাত করে প্রথম স্বাধীন সমান্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার বিলুপ্ত
৮ আগস্ট, ১৯৪৪
মহাত্মা গান্ধীর নির্দেশে, প্রায় দুই বছর সফলভাবে প্রশাসন পরিচালনার পর।
তাঁর স্মৃতিতে ডাকটিকিট প্রকাশ
২০০২
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ৬০ বছর পূর্তিতে জাতীয় সম্মাননা।
১৯৭৭ সালে কলকাতায় তাঁর প্রথম মূর্তি স্থাপন করা হয়, যা স্বাধীন ভারতে প্রথম কোনো মহিলা শহীদকে উৎসর্গীকৃত ।
তমলুকে যেখানে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল, সেখানে তাঁর একটি মূর্তি এখন দাঁড়িয়ে আছে ।
২০০২ সালে, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ষাট বছর পূর্তি উদযাপনের অংশ হিসাবে, ভারত সরকার তাঁর প্রতিকৃতি সম্বলিত ৫ টাকার ডাকটিকিট প্রকাশ করে ।
২০১৫ সালে তাঁর নামে শহীদ মাতঙ্গিনী হাজরা সরকারি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ।
তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল অহিংস প্রতিরোধের একটি ক্রমবর্ধমান পথ—লবণ সত্যাগ্রহ থেকে শুরু করে চৌকিদারি কর বন্ধ আন্দোলন, এমনকি গভর্নরকে কালো পতাকা প্রদর্শনের মতো প্রতীকী বিদ্রোহ পর্যন্ত। কিন্তু তাঁর জীবনের চূড়ান্ত পরীক্ষা আসে ১৯৪২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তমলুক থানা অভিযানে। এই সময়ে, যদিও স্থানীয় আন্দোলনকারীরা ক্ষমতা দখলের মতো বিপ্লবী পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন, মাতঙ্গিনী নিজে চরম সহিংসতার মুখেও অহিংসার আদর্শ থেকে সরে আসেননি। পুলিশকে গুলি না চালানোর আবেদন এবং গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও জাতীয় পতাকা উঁচু করে ধরে রাখা তাঁর নৈতিক প্রতিরোধের চূড়ান্ত রূপ।
মাতঙ্গিনী হাজরার শহীদত্ব ছিল নিছক একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং এটি ছিল একটি সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক প্রক্রিয়া—তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার—প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় আবেগিক ভিত্তি। তাঁর আত্মত্যাগ জনরোষকে একত্রিত করে ব্রিটিশ প্রশাসনকে উৎখাত করার সংকল্পকে আরও শক্তিশালী করেছিল। তিনি কেবল একজন শহীদ নন, বরং বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীশক্তির উত্থানের প্রতীক এবং অহিংস প্রতিরোধের এক জীবন্ত উপাখ্যান হিসেবে আজও ভারতের ইতিহাসে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত।
১.২. অবিভক্ত মেদিনীপুর এবং তমলুক মহকুমার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। ১৯৪২ সালের ‘আগস্ট বিদ্রোহ’ চলাকালে এই জেলায় আন্দোলনের তীব্রতা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, ব্রিটিশ প্রশাসনকে তা দমন করতে চরম বেগ পেতে হয়েছিল। এই অঞ্চলের জনগণ কেবল মহাত্মা গান্ধীর ‘ভারত ছাড়ো’ আহ্বানে সাড়া দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং তারা এই আন্দোলনকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একটি সম্পূর্ণ স্থানীয় অভ্যুত্থানে পরিণত করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন।মেদিনীপুরের বিপ্লবীদের ক্ষোভ কেবল আইন অমান্য বা প্রতীকী প্রতিরোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁদের লক্ষ্য ছিল সুদূরপ্রসারী—ব্রিটিশদের উৎখাত করে স্থানীয়ভাবে ভারতীয়দের একটি সমান্তরাল সরকার স্থাপন করা। এই পরিকল্পনা নির্দেশ করে যে মেদিনীপুরের আন্দোলন একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার চেয়েও বেশি কিছু ছিল; এর পেছনে ছিল এক গভীর সাংগঠনিক কাঠামো এবং স্থানীয়ভাবে ক্ষমতা দখলের সুচিন্তিত রণনীতি।
কিছু ঐতিহাসিক মতে, এই আন্দোলন সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ বাহিনীর জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ হতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে, মাতঙ্গিনী হাজরার মতো একজন গান্ধীবাদী নেত্রীর নেতৃত্ব, চূড়ান্ত মুহূর্তে বিপ্লবের সম্মুখভাগে থাকা, মেদিনীপুরের গণ-আন্দোলনের অসামান্য ক্ষমতা ও রাজনৈতিক সচেতনতাকে স্পষ্ট করে তোলে।
২. সামাজিক প্রেক্ষাপট ও গান্ধীবাদী আদর্শের গ্রহণ
২.১. শৈশব, বিবাহ, এবং দারিদ্র্য: নিরক্ষর কৃষক কন্যার ব্যক্তিগত জীবন
মাতঙ্গিনী হাজরার প্রাথমিক জীবন ছিল প্রতিকূলতায় পূর্ণ। তিনি ১৮৭০ সালের ১৯ অক্টোবর তমলুক থানার অন্তর্গত হোগলা গ্রামে দরিদ্র কৃষক ঠাকুরদাস মাইতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন । তৎকালীন সমাজের দারিদ্র্যের কারণে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের সুযোগ পাননি । সমাজের প্রচলিত বাল্যবিবাহ প্রথা অনুযায়ী, মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি আলিনান গ্রামের ৬০ বছর বয়সী ত্রিলোচন হাজরার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ।কিন্তু এই বিবাহিত জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মাত্র ১৮ বছর বয়সে, কোনো সন্তান ছাড়াই তিনি বিধবা হন । বিধবা হওয়ার পর তিনি তাঁর পৈতৃক গ্রামে ফিরে আসেন এবং দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন শুরু করেন। সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও, মাতঙ্গিনী জীবনের এই কঠোরতাগুলিকে অতিক্রম করার জন্য আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
২.২. মানবতাবাদী ভূমিকা ও সমাজসেবা
বিধবা হওয়ার পর মাতঙ্গিনী তাঁর জীবনের একটি বড় অংশ মানবতাবাদী কাজে এবং সমাজসেবায় উৎসর্গ করেন । এই সময়টি ছিল তাঁর পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনের ভিত্তিভূমি। তিনি সর্বদা মানবতাবাদী উদ্দেশ্য সাধনে নিয়োজিত থাকতেন । বিশেষত, যখন তাঁর অঞ্চলে বসন্ত-রোগের মহামারী দেখা দেয়, তখন তিনি আক্রান্ত পুরুষ, নারী ও শিশুদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন ।মাতঙ্গিনী ছিলেন সামাজিক দিক থেকে দুর্বল—নিরক্ষর, বিধবা এবং দরিদ্র কৃষক পরিবারের কন্যা। এই প্রেক্ষাপটে, তাঁর সমাজসেবামূলক কাজগুলি তাঁকে স্থানীয় সমাজে গভীর রাজনৈতিক বৈধতা এনে দেয়। এই নৈতিক পুঁজিই তাঁকে পরবর্তীকালে হাজার হাজার মানুষের নেতৃত্ব দেওয়ার সাহস ও অধিকার জুগিয়েছিল, যা আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত বা উচ্চবর্গীয় নেতৃত্বের অভাবকে অতিক্রম করে গিয়েছিল। জনগণের সেবায় তাঁর এই নিবেদন তাঁকে সাধারণ মানুষের অত্যন্ত কাছের করে তুলেছিল ।
২.৩. আদর্শের প্রতি অঙ্গীকার: মহাত্মা গান্ধীর প্রতি আকর্ষণ ও ‘গান্ধী বুড়ি’ উপাধি লাভ
১৯০৫ সাল থেকে বাংলায় যখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে, তখন মাতঙ্গিনী হাজরা মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ ও শিক্ষায় গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হন। তিনি গান্ধীর অহিংস ধর্মমতকে আন্তরিকভাবে অনুসরণ করেন। গান্ধীবাদী জীবনযাত্রার অংশ হিসেবে তিনি চরকায় সুতা কাটা এবং খদ্দরের কাপড় বোনার কাজে আত্মনিয়োগ করেন ।গান্ধীজীর নীতির প্রতি তাঁর এই অটল প্রতিশ্রুতির কারণে জনগণ তাঁকে স্নেহভরে ‘গান্ধী বুড়ি’ (বৃদ্ধা গান্ধী) নামে ডাকত। এই উপাধিটি কেবল তাঁর বয়সকেই নির্দেশ করে না, বরং এটি তাঁর আদর্শিক আনুগত্যকেও তুলে ধরে। মেদিনীপুরের মতো একটি অঞ্চলে, যেখানে সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের প্রভাবও ছিল, সেখানে একজন কট্টর গান্ধীবাদীর এমন জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে যে, অহিংসার আদর্শ তৃণমূল পর্যায়ে গভীর শিকড় গেড়েছিল। এই আদর্শিক ভিত্তিই তাঁকে ১৯৪২ সালের চূড়ান্ত সংঘর্ষের সময় অহিংসার পথে অটল থাকতে সাহায্য করেছিল।
৩. রাজনৈতিক জীবনের বিকাশ (১৯৩০-১৯৪১): অহিংস প্রতিরোধের পথ
মাতঙ্গিনী হাজরার সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় তুলনামূলকভাবে দেরিতে, কিন্তু অত্যন্ত দ্রুততার সাথে। তিনি ৬০ বছর বয়সে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল স্রোতে মিশে যান।৩.১. আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদান (১৯৩০): লবণ সত্যাগ্রহ ও প্রথম কারাবরণ
১৯৩০ সালে দেশব্যাপী আইন অমান্য আন্দোলনের সময় মাতঙ্গিনী হাজরা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন । মাত্র ৬০ বছর বয়সে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ প্রমাণ করে যে স্বাধীনতা সংগ্রাম কেবল যুবকদের কাজ ছিল না, বরং এটি সমাজের সকল বয়সের মানুষের মধ্যে দেশপ্রেমের গভীর তাড়না সৃষ্টি করেছিল। তিনি লবণ সত্যাগ্রহে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং মেদিনীপুরের কাঁথিতে প্রথম লবণ তৈরির কাজ শুরু হলে তিনি আলিনান লবণ কেন্দ্রে লবণ উৎপাদন করেন। লবণ আইন অমান্য করার অভিযোগে তাঁকে প্রথমবার গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে নারী হওয়ার কারণে পুলিশ তাঁকে ছেড়ে দেয়। তিনি পুনরায় আন্দোলনে যোগ দেন। এবার গ্রেপ্তার হওয়ার পর শাস্তি হিসেবে পুলিশ তাঁকে দীর্ঘ পথ হেঁটে যেতে বাধ্য করে।৩.২. চৌকিদারি কর বিরোধী আন্দোলন ও কারাবাস
লবণ সত্যাগ্রহের পর তিনি চৌকিদারি ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়ার আন্দোলনে অংশ নেন। এই আন্দোলন গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেওয়া করের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিরোধ ছিল। চৌকিদারি কর বন্ধ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের শাস্তিদানের উদ্দেশ্যে সরকার কর্তৃক গঠিত বেআইনি আদালতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে স্লোগান দেওয়ার সময়ে তাঁকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয় । এই সময় তাঁকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং বহরমপুর জেলে পাঠানো হয়।৩.৩. সাংগঠনিক সক্রিয়তা ও অদম্য সাহস
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর মাতঙ্গিনী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কাজে আরও সক্রিয়ভাবে জড়িত হন। তিনি গান্ধীর সত্যিকার অনুসারীর মতো চরকা ও খাদি তৈরি অব্যাহত রাখেন। ১৯৩৩ সালে তিনি শ্রীরামপুর মহকুমা কংগ্রেস সম্মেলনে যোগ দেন এবং সেখানে প্রতিবাদকারীদের উপর পুলিশ লাঠিচার্জ করলেও তিনি সরে যাননি ।একই বছর, অর্থাৎ ১৯৩৩ সালে, তাঁর সাহসিকতার এক চরম পরীক্ষা দেখা যায়। বাংলার গভর্নর স্যার জন অ্যান্ডারসন যখন তমলুক পরিদর্শনে আসেন, তখন মাতঙ্গিনী কৌশলে নিরাপত্তা এড়িয়ে মঞ্চে পৌঁছে যান এবং গভর্নরের সামনে কালো পতাকা নাড়িয়ে দেন। এটি ছিল প্রতীকীভাবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্তৃত্বকে সরাসরি অস্বীকার করার চরমতম উদাহরণ। এই নির্ভীক কাজের জন্য তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হয় এবং ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয় ।
তাঁর ৬০ বছর বয়সে রাজনৈতিক জীবনে সূচনা এবং গভর্নরের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ তাঁকে স্থানীয় জনগণের চোখে কেবল একজন কর্মী হিসেবে নয়, বরং একজন নির্ভীক, সরকারের চোখে চোখ রাখা নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। তাঁর এই বিলম্বিত কিন্তু তীব্র শুরু গ্রামীণ বয়স্ক মহিলাদের জন্য একটি শক্তিশালী উদাহরণ তৈরি করে, যা ১৯৪২ সালে তাঁর নেতৃত্বে বিশাল জনসমাবেশে প্রতিফলিত হয়েছিল।
মাতঙ্গিনী হাজরার রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ নিম্নলিখিত সারণীতে তুলে ধরা হলো:
মাতঙ্গিনী হাজরার রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ (১৯৩০-১৯৪২)
সময়কাল
আন্দোলনের নাম
মাতঙ্গিনী হাজরার ভূমিকা
ফলাফল
উৎস
১৯৩০ (৬০ বছর বয়সে)
আইন অমান্য আন্দোলন (লবণ সত্যাগ্রহ)
আলিনানে লবণ উৎপাদন, আইন ভঙ্গ, কংগ্রেসে যোগদান
প্রথমবার গ্রেপ্তার ও মুক্তি
১৯৩২
চৌকিদারি কর বন্ধ আন্দোলন
বেআইনি আদালতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
ছয় মাস কারাদণ্ড ও বহরমপুর জেলে প্রেরণ
১৯৩৩
গভর্নরের প্রতি প্রতিবাদ
বাংলার গভর্নর স্যার জন অ্যান্ডারসনের সামনে কালো পতাকা প্রদর্শন
ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ড
২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪২ (৭২/৭৩ বছর বয়সে)
ভারত ছাড়ো আন্দোলন (তমলুক থানা অভিযান)
৬,০০০ মানুষের শোভাযাত্রার নেতৃত্ব, পতাকা উত্তোলন
ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে শহীদ
৪. ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে মাতঙ্গিনী (১৯৪২)
৪.১. ‘করো অথবা মরো’ আহ্বান এবং মেদিনীপুরে জনবিস্ফোরণ
১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট মহাত্মা গান্ধী যখন ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক দেন এবং জনগণকে ‘করো অথবা মরো’ (Do or Die) মন্ত্রে দীক্ষিত করেন, তখন ভারতের সর্বত্র এই আন্দোলনের আঁচ ছড়িয়ে পড়ে। মেদিনীপুর জেলায় এই আহ্বানের তীব্রতা ছিল সর্বাধিক। এই আন্দোলন সেখানে কেবল গণ-অসহযোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং এটি ‘আগস্ট বিদ্রোহ’-এর রূপ নেয়। মেদিনীপুর অঞ্চলে আন্দোলন এমন আকার ধারণ করে যে ব্রিটিশরা তা স্বপ্নেও ভাবেনি ।৪.২. তমলুক অঞ্চলে আন্দোলনের রণনীতি: সরকারি অফিস দখলের পরিকল্পনা
ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে যখন আন্দোলন চলছে, তখন মেদিনীপুরের বিপ্লবীরা ঠিক করেন যে, তাঁরা ব্রিটিশদের উৎখাত করে তাঁর বদলে ভারতীয়দের সরকার স্থাপন করবেন। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা ভারতের অন্যান্য স্থানের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন থেকে মেদিনীপুরকে আলাদা করে তুলেছিল। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্থানীয় প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু—যেমন তমলুক মহকুমার থানা, আদালত ও অন্যান্য সরকারি অফিস—জোরপূর্বক দখল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই আক্রমণের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনকে অচল করে দিয়ে সমান্তরাল সরকার গঠনের পথ প্রশস্ত করাই ছিল মূল লক্ষ্য। যদিও মাতঙ্গিনী ছিলেন একজন কঠোর গান্ধীবাদী, কিন্তু স্থানীয় বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতার প্রতীকী দখল, যা অহিংস প্রতিরোধের চূড়ান্ত সীমা চিহ্নিত করে।৪.৩. ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪২: তমলুক থানা অভিযানের নেতৃত্ব
মাতঙ্গিনী হাজরার সাহসিকতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজটি আসে ১৯৪২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর । এই দিনে, ৭২ বা ৭৩ বছর বয়সী এই নেত্রীর নেতৃত্বে প্রায় ছয় হাজার (কিছু সূত্র অনুযায়ী ৬,০০০ সমর্থক, কিছু সূত্র অনুযায়ী ছয় হাজার মহিলা স্বেচ্ছাসেবক) মানুষের এক বিশাল শোভাযাত্রা তমলুক পুলিশ স্টেশন দখলের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলে ।বিপ্লবী কর্মকাণ্ডর জন্য জেলবন্দি থাকার পরও জেল থেকে ছাড়া পেয়েই মাতঙ্গিনী মানুষের সেবায় ছুটে যেতেন । এই কারণেই তিনি জনগণের খুবই কাছের ছিলেন। শোভাযাত্রার একেবারে সম্মুখে তিনি হাতে ত্রিবর্ণ জাতীয় পতাকা ধারণ করে এগিয়ে চলছিলেন। এই সময়ে একটি বৃদ্ধা নারীর নিজে মিছিলের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া ছিল অবিশ্বাস্য, যা ভাবলে মনে হয় কল্পকাহিনি, কিন্তু বাস্তব মাঝে মাঝে কল্পনার থেকেও এগিয়ে থাকে ।
৪.৪. জনশক্তির প্রতীক: বৃদ্ধা বয়সেও শোভাযাত্রার সম্মুখভাগে তাঁর অবস্থান
মাতঙ্গিনীর এই বিশাল শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেওয়া প্রমাণ করে জনগণের মধ্যে তাঁর গভীর নৈতিক ও সাংগঠনিক প্রভাব। তাঁর এই উপস্থিতি কেবল প্রতীকী ছিল না; এটি ছিল গ্রামীণ জনসাধারণের, বিশেষত মহিলাদের, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার চূড়ান্ত প্রকাশ।তমলুকের স্থানীয় নেতারা, মাতঙ্গিনী সহ, জানতেন যে এই আন্দোলন কেবল ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়, এটি একটি সংগঠিত বিপ্লব। তাদের এই কৌশলই সরাসরি তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি তৈরি করেছিল । এই অভিযান প্রমাণ করে যে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে মেদিনীপুরের বিপ্লবীরা সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত ছিলেন, যার ফলস্বরূপ মাতঙ্গিনী তাঁর জীবন উৎসর্গ করেন।
৫. শহীদত্ব লাভ: নির্ভীকতা ও জাতীয় পতাকার সম্মান রক্ষা (২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪২)
মাতঙ্গিনী হাজরার মৃত্যু কেবল একটি দুঃখজনক ঘটনা ছিল না, বরং এটি ছিল অহিংস প্রতিরোধের পথে চূড়ান্ত আত্মত্যাগ এবং একটি নৈতিক বিজয়।৫.১. পুলিশের প্রতিরোধ ও ১৪৪ ধারা
মাতঙ্গিনীর নেতৃত্বে শোভাযাত্রাটি তমলুক আদালত প্রাঙ্গণের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় বাণ পুকুরের পাড়ে সংকীর্ণ গলির মুখে ব্রিটিশ প্রশাসনের পুলিশ প্রচণ্ডভাবে বাধা দেয়। ব্রিটিশ পুলিশ ১৪৪ ধারা জারির কথা ঘোষণা করে এবং জনগণকে ছত্রভঙ্গ করতে গুলি চালানোর প্রস্তুতি নেয় । লক্ষ্যণীয়, পুলিশের নেতৃত্বে ছিলেন একজন বাঙালি অফিসার, অনিল কুমার ভট্টাচার্য ।মাতঙ্গিনী হাজরা পুলিশের হুঙ্কার শুনে দমে যাননি। তিনি হাতে জাতীয় পতাকা উঁচু করে ধরে এগিয়ে যেতে থাকেন, তাঁর চোখেমুখে কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না । তিনি তাঁর গান্ধীবাদী আদর্শের প্রতি অটল থেকে, অহিংস পথে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তিনি মরণকে আলিঙ্গন করেছিলেন এই বিশ্বাসে যে, ‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান’ ।
৫.২. গুলিবিদ্ধ হওয়ার মর্মান্তিক মুহূর্ত: তিনটি গুলির বিশ্লেষণ
পুলিশ ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুঁড়তে শুরু করলে, নির্ভীক মাতঙ্গিনী এগিয়ে যান। তিনি সিপাইদের উদ্দেশ্যে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাতে থাকেন, যেন তারা নিজেদের ‘ভ্রাতৃবর্গের উপর গুলি না চালায়’ এবং দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য চাকরি ছেড়ে আন্দোলনে যোগ দেয় ।বিপ্লবী সংবাদপত্র ‘বিপ্লবী’ অনুযায়ী, তিনি যখন এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন পুলিশ তাঁকে লক্ষ্য করে তিনবার গুলি চালায় ।
প্রথম গুলি: প্রথম গুলিটি মাতঙ্গিনীর বামহাতের কনুইয়ে বিদ্ধ হয়। এই আঘাতে তাঁর হাত থেকে শাঁখ পড়ে যায়, কিন্তু তিনি আঘাতের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে জাতীয় পতাকা নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন ।
দ্বিতীয় গুলি: দ্বিতীয় গুলিটি এসে তাঁর ডান হাতের কনুইয়ে লাগে। কিন্তু এই আঘাত সত্ত্বেও তিনি পতাকা ছাড়েননি ।
তৃতীয় ও চূড়ান্ত গুলি: চূড়ান্ত মুহূর্তে তৃতীয় গুলিটি এসে তাঁর কপালে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে ৭২/৭৩ বছর বয়সী এই বীরাঙ্গনা নারীর দেহটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
৫.৩. মৃত্যুকালে ধ্বনি ও জাতীয় পতাকার সম্মান রক্ষা
গুলিবিদ্ধ অবস্থায়, তিনি ক্রমাগত ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি দিতে থাকেন। তিনি জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে উঁচু করে ধরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । তাঁর এই আত্মত্যাগ ছিল অহিংস প্রতিরোধের পথে ‘করো অথবা মরো’ মন্ত্রের এক চূড়ান্ত প্রকাশ। চরম সহিংস আক্রমণের মুখেও তিনি নৈতিক অবস্থান বজায় রেখেছিলেন (সত্যাগ্রহ)। তাঁর মৃত্যু একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক বার্তা তৈরি করে—ব্রিটিশ শক্তি একজন দুর্বল নারীকে হত্যা করতে পারে, কিন্তু তাঁর নৈতিক আদর্শকে পরাজিত করতে পারে না। তিনি স্বাধীনতার কারণের প্রতি তাঁর অটল প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন ।৬. আত্মত্যাগের তাৎক্ষণিক ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব: তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার (TJS)
মাতঙ্গিনী হাজরার হত্যাকাণ্ড মেদিনীপুরের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বাঁক তৈরি করে, যা প্রতীকী প্রতিরোধকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্রোহে পরিণত করে। তাঁর আত্মত্যাগ স্থানীয় জনগণের জন্য অপরিহার্য আবেগিক এবং রাজনৈতিক প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল।৬.১. মাতঙ্গিনী হাজরার শহীদ হওয়ার পর জনগণের প্রতিক্রিয়া
২৯ সেপ্টেম্বর মাতঙ্গিনীর শহীদ হওয়ার ঘটনা জনগণের মধ্যে এক চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং সংগ্রামের আগুন দাবানলের মতো জ্বলে ওঠে। তাঁর মৃত্যু জনগণের ওপর এক চমকপ্রদ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ফেলেছিল। মেদিনীপুরের সাধারণ মানুষ ব্রিটিশ প্রশাসনের প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত ও বীতশ্রদ্ধ ছিল। তারা প্রতিটি সরকারি ভবন দখল করে নেয় এবং স্থানীয়ভাবে ব্রিটিশ প্রশাসনকে উৎখাত করার জন্য প্রস্তুত হয়।৬.২. তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা: শহীদত্বের প্রত্যক্ষ ফল (১৭ ডিসেম্বর, ১৯৪২)
মাতঙ্গিনী হাজরার আত্মত্যাগের প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ, মেদিনীপুরের বিপ্লবীরা তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্রুত ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া শুরু করেন । তাঁর শহীদ হওয়ার মাত্র সাড়ে ১১ সপ্তাহ পরে, ১৯৪২ সালের ১৭ ডিসেম্বর তমলুক ও কাঁথি মহকুমায় ব্রিটিশ শাসনকে উৎখাত করে প্রথম স্বাধীন সমান্তরাল সরকার, তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার (Tamralipta Jatiya Sarkar – TJS), প্রতিষ্ঠিত হয় । এটি ছিল ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে গঠিত প্রথম অ-ব্রিটিশ সরকারগুলির মধ্যে অন্যতম ।মাতঙ্গিনী যদিও সরকার প্রতিষ্ঠার আগেই শহীদ হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর বলিদান নিশ্চিত করেছিল যে জনগণের ক্রোধ ব্রিটিশ প্রশাসনকে উৎখাত করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠবে। তাঁর মৃত্যু জনরোষকে সংগঠিত করার জন্য একটি কেন্দ্রবিন্দু বা Catalyst হিসেবে কাজ করে। এই সরকার গঠনে সতীশচন্দ্র সামন্ত, সুশীল কুমার ধাড়া, অজয় মুখোপাধ্যায় এবং মাতঙ্গিনী হাজরা প্রধান নেতা হিসেবে ভূমিকা পালন করেন ।
৬.৩. জাতীয় সরকারের কাঠামো, কার্যক্রম ও সময়কাল (১৯৪২-১৯৪৪)
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার ছিল এক সুসংগঠিত স্বাধীন সমান্তরাল প্রশাসন ।নেতৃত্ব ও প্রশাসন: বিপ্লবী সতীশচন্দ্র সামন্ত সর্বাধিনায়ক হন। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজয় কুমার মুখোপাধ্যায় অর্থসচিব এবং সুশীল কুমার ধাড়া সমর ও স্বরাষ্ট্রসচিবের দায়িত্ব পালন করেন ।
শাসনব্যবস্থা ও কার্যক্রম: TJS পৃথক শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, যার মধ্যে ছিল আইন-শৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিচার, কৃষি, প্রচার, সমর ইত্যাদি বিভাগ । এই সরকারের নিজস্ব মুখপত্র, ‘বিপ্লবী’, প্রকাশিত হত । এই জাতীয় সরকার ঘূর্ণিঝড়-বিধ্বস্ত এলাকায় ত্রাণকার্যও চালায়, যা জনগণের মধ্যে তাদের বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল ।
বিলুপ্তি: তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার সফলভাবে প্রায় দুই বছর কাজ করেছিল এবং ১৯৪৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কার্যকর ছিল। অবশেষে, মহাত্মা গান্ধীর নির্দেশে ১৯৪৪ সালের ৮ আগস্ট এই সরকার বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় ।
মাতঙ্গিনীর আত্মত্যাগ এবং তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার মধ্যে থাকা কার্যকারণ সম্পর্ক নিম্নোক্ত সারণীতে স্পষ্ট:
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা ও মাতঙ্গিনী হাজরার প্রভাব
ঘটনা
তারিখ
তাৎপর্য ও প্রভাব
উৎস
মাতঙ্গিনী হাজরার শহীদত্ব লাভ
২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪২
তমলুক থানা দখলের প্রচেষ্টার সময় মৃত্যু, আন্দোলনের জন্য চরম প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গঠিত
১৭ ডিসেম্বর, ১৯৪২
মাতঙ্গিনীর আত্মত্যাগের প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ, ব্রিটিশ শাসনকে উৎখাত করে প্রথম স্বাধীন সমান্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার বিলুপ্ত
৮ আগস্ট, ১৯৪৪
মহাত্মা গান্ধীর নির্দেশে, প্রায় দুই বছর সফলভাবে প্রশাসন পরিচালনার পর।
তাঁর স্মৃতিতে ডাকটিকিট প্রকাশ
২০০২
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ৬০ বছর পূর্তিতে জাতীয় সম্মাননা।
৬.৪. উত্তরাধিকার ও স্মারক
মাতঙ্গিনী হাজরার অটল দৃঢ়তা এবং স্বাধীনতার কারণের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অমোঘ চিহ্ন রেখে গেছে । তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য স্বাধীন ভারতে তাঁকে একাধিক সম্মাননা প্রদান করা হয়:১৯৭৭ সালে কলকাতায় তাঁর প্রথম মূর্তি স্থাপন করা হয়, যা স্বাধীন ভারতে প্রথম কোনো মহিলা শহীদকে উৎসর্গীকৃত ।
তমলুকে যেখানে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল, সেখানে তাঁর একটি মূর্তি এখন দাঁড়িয়ে আছে ।
২০০২ সালে, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ষাট বছর পূর্তি উদযাপনের অংশ হিসাবে, ভারত সরকার তাঁর প্রতিকৃতি সম্বলিত ৫ টাকার ডাকটিকিট প্রকাশ করে ।
২০১৫ সালে তাঁর নামে শহীদ মাতঙ্গিনী হাজরা সরকারি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ।
৭. উপসংহার: মাতঙ্গিনী হাজরা: নারী-বিপ্লব ও গান্ধীবাদী প্রতিরোধের অমর গাঁথা
মাতঙ্গিনী হাজরার জীবন ও আত্মত্যাগ ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের অদম্য চেতনার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। একজন নিরক্ষর, দরিদ্র কৃষক কন্যা, যিনি ৬০ বছর বয়সে রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করেন, তিনি দেখিয়েছেন যে সাহস এবং দৃঢ় সংকল্প বয়স বা সামাজিক বাধা দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। তাঁকে দেওয়া ‘গান্ধী বুড়ি’ উপাধিটি কেবল তাঁর আদর্শিক আনুগত্যকেই তুলে ধরে না, বরং তাঁর নৈতিক শক্তির গভীরতাকেও প্রকাশ করে।তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল অহিংস প্রতিরোধের একটি ক্রমবর্ধমান পথ—লবণ সত্যাগ্রহ থেকে শুরু করে চৌকিদারি কর বন্ধ আন্দোলন, এমনকি গভর্নরকে কালো পতাকা প্রদর্শনের মতো প্রতীকী বিদ্রোহ পর্যন্ত। কিন্তু তাঁর জীবনের চূড়ান্ত পরীক্ষা আসে ১৯৪২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তমলুক থানা অভিযানে। এই সময়ে, যদিও স্থানীয় আন্দোলনকারীরা ক্ষমতা দখলের মতো বিপ্লবী পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন, মাতঙ্গিনী নিজে চরম সহিংসতার মুখেও অহিংসার আদর্শ থেকে সরে আসেননি। পুলিশকে গুলি না চালানোর আবেদন এবং গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও জাতীয় পতাকা উঁচু করে ধরে রাখা তাঁর নৈতিক প্রতিরোধের চূড়ান্ত রূপ।
মাতঙ্গিনী হাজরার শহীদত্ব ছিল নিছক একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং এটি ছিল একটি সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক প্রক্রিয়া—তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার—প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় আবেগিক ভিত্তি। তাঁর আত্মত্যাগ জনরোষকে একত্রিত করে ব্রিটিশ প্রশাসনকে উৎখাত করার সংকল্পকে আরও শক্তিশালী করেছিল। তিনি কেবল একজন শহীদ নন, বরং বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীশক্তির উত্থানের প্রতীক এবং অহিংস প্রতিরোধের এক জীবন্ত উপাখ্যান হিসেবে আজও ভারতের ইতিহাসে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত।
তথ্যসূত্র :
1. হাজরা, মাতঙ্গিনী - বাংলাপিডিয়া :https://bn.banglapedia.org
2. Matangini Hazra - Wikipedia :
https://en.wikipedia.org/wiki/Matangini_Hazra
3. Matangini Hazra - RACE IAS :
https://raceias.com/index.php/current-affairs/matangini-hazra
4. আজকের রাত-দখলের অনুপ্রেরণা মাতঙ্গিনী হাজরা! - Dainik Statesman :
https://www.dainikstatesmannews.com/editorial/todays-night-occupation-inspiration-matangini-hazra/96717
5. Tittee- মাতঙ্গিনী হাজরা File No-31 - মেদিনীপুরের তমলুক মহকুমার ২৯শে সেপ্টেম্বরের ঘটনা বোধহয় কোনোদিনই ভোলা যাবে না। - Raghunathpur College :
https://elearning.raghunathpurcollege.ac.in/files/532FD3ED15882180230.pdf
6. Matangini Hazra - Freedom's Champion - Women in Indian History :
https://savitanarayan.blogspot.com/2020/12/matangini-hazra-freedoms-champion.html
7. মাতঙ্গিনী হাজরার আন্দোলনের পিছনে ছিল বড় পরিকল্পনা, পাল্টে যেতে পারত ভারতের ইতিহাস :
https://inscript.me/tamralipta-government-was-an-effort-to-support-netajis-plan
8. A pocket of Bengal that formed the first non-British government in India on December 17, 1942 | Kolkata News :
https://timesofindia.indiatimes.com/city/kolkata/a-pocket-of-bengal-that-formed-the-first-non-british-government-in-india-on-december-17-1942/articleshow/93532258.cms
9. বিপ্লবী মাতঙ্গিনী হাজরা - Independent Television :
https://www.itvbd.com

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন